স্বামী অখণ্ডানন্দ বলেছেন, “বরং গোখরো সাপ পোষ মানে, তবে মানুষ বসে আসে না। স্বামীজিও শেষ দিকটায় মানুষের উপর বিরক্ত হয়ে, শরীর ছাড়বার আগে মায়ার বন্ধন কাটাতে মানুষের সংস্রব একরকম ছেড়ে দিয়েছিলেন।”
অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে–মানুষের উপর বিশ্বাস মোটেই টলেনি, কিন্তু বাল্যের কিছু অভ্যাস ফিরে আসতে চাইছিল তার মধ্যে। যেমন পশুপক্ষীর প্রতি প্রবল আগ্রহ।
পায়রার শখটা স্বামীজি পেয়েছিলেন তার মামাহীন মামার বাড়ির দিক থেকে। জননী ভুবনেশ্বরীও পায়রা ভালবাসতেন বলে বাড়িতে বরাবর পায়রা থাকতো। ছোটবেলায় স্বামীজির খেয়াল হল ময়ূর, ছাগল, বাঁদর ইত্যাদি পুষবেন। তিনি নিজের হাতে এদের খাওয়াতেন। ময়ূরটিকে পাড়ার লোকরা ঢিল মেরে মেরে শেষ করল। বাঁদরটি এমন উৎপাত করত যে তাকে বিদায় করার পথ রইল না। মেজভাই মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ছাগলটি গৌরমোহন স্ট্রিটের ঠাকুরদালানের নিচে কিছুদিন ছিল।
স্বামীজির বেশ কিছু বাল্যস্বভাব দুর্জয়ভাবে ফিরে এল মহাসমাধির কিছু আগে। স্বামীজি নিজে দাঁড়িয়ে সব জানোয়ারকে খাবার খাওয়াতেন। “কতকগুলো চিনেহাঁস, রাজহাঁস, পাতিহাঁস একদিকে, ছাগল-ভেড়া একদিকে, পায়রা একদিকে এবং গরু একদিকে।”
স্বামীজি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদের খাওয়া দেখতেন। বেলুড়ের চিড়িয়াখানায় আরও সভ্য ছিল–যেমন কুকুর, সারস, বেড়াল, গাভী, ভেড়া ও হরিণ। এদের সঙ্গে তিনি শুধু কথা বলতেন তা নয়, এদের সুন্দর সুন্দর নাম দিয়েছিলেন। যেমন চিনা হাঁসের নাম যশোবতী, রাজহাঁসের নাম বম্বেটে, ছাগলের নাম হংসী, ছাগলছানার নাম মটরু। প্রিয় কুকুরের নাম বাঘা, আর দুটি কুকুরের নাম মেরি ও টাইগার।
মটরুর গলায় তিনি ঘুঙুর পরিয়ে দিয়েছিলেন। সে স্বামীজির পায়ে পায়ে ঘুরত, স্বামীজিও ছোট ছেলের মতো তার সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করতেন।
মটরু মরে গেলে স্বামীজি দুঃখ করেছিলেন, “কী আশ্চর্য, আমি যেটাকে একটু আদর করতে যাই, সেটাই যায় মরে।” আর একদিন বলেছিলেন, “মটরু নিশ্চয় আর জন্মে আমার কেউ হত!”
মাঝে মাঝে ছাগলী হংসীর কাছে গিয়ে তিনি চায়ের দুধের জন্য এমনভাবে অনুনয়-বিনয় করতেন, যেন দুধ দেওয়া না-দেওয়া হংসীর ইচ্ছাধীন।
স্বামীজির এই সময়কার চিঠিপত্রে তাঁর প্রিয় পশুপাখিদের অনেক খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্বামী গম্ভীরানন্দ তাঁর বইতে নিবেদিতাকে লেখা স্বামীজির চিঠির উল্লেখ করেছেন। “আমার সেই বিশালাকায় সারসটি এবং হংস হংসীগুলি খুবই স্ফুর্তিতে আছে। আমার পোষ কৃষ্ণসারটি মঠ থেকে পালিয়েছিল এবং তাকে খুঁজে বার করতে আমাদের দিনকয়েক বেশ উদ্বেগে কাটাতে হয়েছে। আমার একটি হংসীদুর্ভাগ্যক্রমে কাল মারা গেছে। প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।…একটি রাজহংসীর পালক খসে যাচ্ছিল। আর কোন প্রতিকার জানা না থাকায় একটা টবে খানিকটা জলের সঙ্গে একটু কার্বলিক এসিড মিশিয়ে তাতেই কয়েক মিনিটের জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।…তা হংসীটি এখন ভাল আছে।”
১৯০২ সালে স্বামীজি স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য কাশী গিয়েছিলেন, কিন্তু তখন তার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। ডায়াবিটিসের দাপটে একটি চোখ প্রায় নষ্ট। তখনও কিন্তু তিনি চিঠিতে বেলুড়ে ব্রহ্মানন্দকে অনুরোধ করছেন, “ছাগলটাকে একটু দেখো।”
সিস্টার ক্রিশ্চিনকে বেলুড় মঠ থেকে স্বামীজি এক চিঠিতে (২৭ মে ১৯০২) জানাচ্ছেন, “দুটি ছাগলছানা ও তিনটি ভেড়া সদ্য আমার ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আরও একটি ছাগলছানা ছিল, কিন্তু সে হলদে রঙের মাছের চৌবাচ্চায় ডুবে মরেছে।”
ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে পরিবারের নতুন সদস্যদের দেখতে বেরোবার আগে বিবেকানন্দ লিখছেন, “একটা রাজহাঁস একেবারে বোকা এবং ভীতু সবসময় হতাশ আর কাতর। সে একলা থাকতে চায়, বেচারা বড্ড দুঃখী।”
পশুপালন সম্পর্কে জুন ১৯০১ সালের শেষদিকে বেলুড় মঠ থেকে স্বামীজি তাঁর স্নেহের শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে আর একটি চিঠি লেখেন। “আমার এখানে কয়েকটি ছাগল ভেড়া গোরু কুকুর এবং সারস রয়েছে। সারাদিন ধরে আমি তাদের দেখাশোনা করছি। আমার সুখের জন্যে এই চেষ্টা নয়–তার প্রয়োজন কী? আমরা অসুখীও বা হব না কেন? দুটোরই কোন মানে হয় না। আমি স্রেফ সময় কাটাবার চেষ্টা চালাচ্ছি।”
কয়েকমাস পরে ক্রিশ্চিনের কাছে লেখা চিঠিতে জানা যাচ্ছে, নবজাত দুটি শাবককে বাঁচাবার জন্য তাদের গোরুর দুধ খাওয়াচ্ছেন স্বামীজি, কিন্তু রাতের অন্ধকারে তারা মারা গেল।
“আমার দুটি হাঁস তাদের ডিমে তা দিচ্ছে। যেহেতু এ দুটি তাদের প্রথম সন্তান এবং যেহেতু পুরুষ হাঁসের কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না, সেহেতু আমি নিজেই খাইয়ে-দাইয়ে তাদের শক্তি অটুট রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি। এখানে চিকেন প্রতিপালন হয় না–এই বস্তুটি এখানে নিষিদ্ধ।”
স্বামী অখণ্ডানন্দ কিন্তু নিজের মত পরিবর্তনে রাজি নন। তিনি বলে যাচ্ছেন : “স্বামীজি শেষটায় মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে হতাশ হয়ে জীবজন্তু নিয়ে থাকতেন।…দস্তুরমতো একটা চিড়িয়াখানা তৈরি করেছিলেন। নিজের সেবার টাকা থেকে তাদের জন্য ১০০ টাকা খরচ করতেন।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দের উপর ছিল বাগানের ভার এবং পশুদের হাত থেকে বাগানের ফসল রক্ষার জন্য যে বেড়া দেওয়া হচ্ছে তাও বিদেশিনী ভক্তরা স্বামীজির চিঠি থেকে নিয়মিত জানতে পারছেন। দুই গুরুভাই প্রায়ই বাগান ও গোচারণভূমির সীমা-বিভাগ নিয়ে মধুর কলহে প্রবৃত্ত হতেন এবং তাতে মঠবাসীরা খুব আমোদ উপভোগ করতেন।