বাবামায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে ভুবনেশ্বরী কিছু পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারিণী হয়েছিলেন। পিতার বসতবাটি এবং চারকাঠা সম্পত্তি তার ছেলেরা ভোগদখলের অধিকারী। বিশ্বনাথ নিজেও তাঁর মাতামহের কাছ থেকে একটা বাগানবাড়ি উপহার পেয়েছিলেন।
এবার শুনুন বিবেকানন্দর ছোটভাইয়ের মুখে : “অকস্মাৎ আবির্ভূত হলেন বিশ্বনাথের মেজমামা। তিনি এসে ভাগ্নের কানে কি পরামর্শ দিলেন। বিশ্বনাথ সে সম্পত্তি মামার নামে লিখে দিলেন। আমার মায়ের কাছে এ কাহিনী শুনেছি। তিনি একার্যের সমর্থন করতেন। তিনি বলতেন, ঐ সম্পত্তি লিখে না দিলে মাতামহের কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি কাকাই আত্মসাৎ করে নিতেন। সে সময়ে পরিবারের সমস্ত অংশীদাররা মধু রায় লেনের বাড়ি বিক্রয়ের চেষ্টা করছিলেন। বিশ্বনাথ তাঁর নিজের অংশ কাকার নামে লিখে দেন।”
বিশ্বনাথের মৃত্যু তারিখ কলকাতা কর্পোরেশনের খাতায় লেখা ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪, কিন্তু হাইকোর্টে ভুবনেশ্বরীর আবেদনপত্র অনুযায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪, তবে তাঁর মৃত্যুকালীন বাসস্থান যে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট তার প্রমাণ কর্পোরেশনের খাতায় রয়েছে। রাত্রে তার বুকে ব্যথা ও হার্ট অ্যাটাক হয়, যদিও ডেথ রেজিস্টারে কেবল ডায়াবিটিসের উল্লেখ আছে। শ্মশানে সংবাদদাতা হিসেবে ইংরিজিতে পুরো স্বাক্ষর করেছেন পুত্র নরেন্দ্রনাথ দত্ত। আকস্মিক মৃত্যুকালে নরেন্দ্রনাথ এক বন্ধুর বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে গিয়েছিলেন, গভীর রাতে তিনি খবর পান এবং বোধহয় সোজা শ্মশানে চলে আসেন। ভূপেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, “পরদিন সকালবেলায় তাঁর বড় ছেলের জন্যে কনে দেখতে যাবার কথা ছিল।”
নরেন্দ্রনাথের বিবাহ প্রস্তাব সম্পর্কে বেশ কিছু বিবরণ ভূপেন্দ্রনাথের লেখায় পাওয়া যায়। পিতার মৃত্যুর পরেও পিতৃবন্ধু কলকাতার হাইকোর্টের এক এটর্নি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যদি তার নাতনীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাহলে তিনি পারিবারিক মামলার সব ব্যয়ভার বহন করবেন।
পিতা-পুত্রের মৃত্যুর আকস্মিকতার মধ্যেও যথেষ্ট মিল আছে। সঙ্কট আসে রাত ন’টা নাগাদ। সন্ন্যাসী পুত্রের মৃত্যুসংবাদ বেলুড় থেকে এক সকালে কলকাতায় এল। মা জানতে চাইলেন হঠাৎকী হলো? ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, “বাবার যা হয়েছিল।” মা ও দিদিমা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লেন।
ভুবনেশ্বরীর জন্ম ১৮৪১ সালে, স্বামীর যখন ১৬ বছর বয়স তখন বিয়ে, পরের পর দশটি সন্তানকে গর্ভে ধারণ। একের পর এক সন্তানশোক পেয়েছেন। তেতাল্লিশ বছর বয়সে কপর্দকশূন্য অবস্থায় নাবালক ছেলেমেয়ে নিয়ে বৈধব্য, প্রায় একই সময় প্রাণান্তকর মামলায় ভিটেমাটি ছাড়া হওয়ার অবস্থা, যে ছেলে রোজগেরে হয়ে সংসারের হাল ধরতে পারতো তার সন্ন্যাস গ্রহণ, কন্যার আত্মহনন এবং একষট্টি বছর বয়সে সন্ন্যাসীপুত্রের মৃতদেহের সামনে বসে থাকা। সংসারে একজন মায়ের জন্য আর কত যন্ত্রণাই বা থাকতে পারে?
সময়সীমার অনেক আগেই মৃত্যু উপস্থিত হয়ে বিবেকবান সন্ন্যাসীর সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়েছিল কেমনভাবে তা কারও অজানা নয়। কিন্তু জীবনযাত্রার মধ্যপথে কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরে নগ্নপদে বিচরণ করতে গিয়ে তিনি কেমনভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন এবং রক্তমাখা চরণতলে পথের কাটাকে তিনি কেমন নির্ভীকভাবে দলনের চেষ্টা করেছিলেন তার সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা থাকলে, এদেশের সংখ্যাহীন হতদরিদ্র এবং ভাগ্যহত মানুষ জীবনসংগ্রামে জয়ী হবার ভরসা খুঁজে পাবেন। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, জীবন কী তার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তার অনুগত শিষ্য এবং দুঃখ দিনের পরম বন্ধু খেতড়ির রাজা অজিত সিংকে স্বামীজি বলেছিলেন, সতত প্রতিকূল অবস্থামালার বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ এবং আত্মবিকাশের চেষ্টার নামই জীবন।
*
সুখের সংসারে আগুন লেগে রাতারাতি বাঙালি পরিবার কীভাবে বিপর্যস্ত হয় তার ছবি আঁকার আগে সুখী গৃহকোণের আরও দু’একটা খবর সংগ্রহ করা যাক।
দাদা নরেন যে কমবয়স থেকে নস্যি নিতেন এবং মশারিতে তার গন্ধ পাওয়া যেতো একথা মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ সবিনয়ে আমাদের জানিয়েছেন। পায়রা ওড়াবার পারিবারিক শখ ছিল, আঙুলের কায়দায় দেওয়ালে ছায়াছবি দেখিয়ে নরেন্দ্রনাথ ভাইদের তাক লাগাতেন, খেলতেন একধরনের ক্রিকেট যার তদানীন্তন বাংলা নাম ব্যাটম্বল। এক মাস্টারমশাই তার মেজভাইয়ের মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন বলে স্কুল সুপার ব্রজেন্দ্রনাথ দে-কেনরেন্দ্রনাথ এমন চিঠি লিখেছিলেন যে মাস্টারমশায়ের যোগ্য শাস্তি হয়েছিল।
গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী একবার স্বামী অখণ্ডানন্দকে বলেছিলেন, বালককালে এবং বড় হয়েও আমার বড় ছেলে কখনও বেলা অবধি ঘুমোয়নি। যত দেরিতেই শোওয়া হোক, বিলু উঠতো খুব ভোরে।
সেকালে প্রতিষ্ঠিত পরিবারে নাপিতদের গৃহ আগমনে ক্ষৌরকার্য সম্পন্ন হতো। বিবেকানন্দকে কিন্তু বেলুড়ে আমরা ঝটপট ক্ষুর চালাতে দেখেছি। আয়না সামনে না রেখেই এই কাজ তিনি নিপুণভাবে সম্পন্ন করতে পারতেন এবং রসিকতা করে বলতেন আমেরিকায় তার দুর্ভোগের কথা। এক সেলুনে তাঁর দাড়ি কামানো হলো না, কারণ একজন কালা আদমিকে কামালে সায়েবরা আর এই দোকানের দিকে পা বাড়াবেন না।