শুনুন স্বামী অখানন্দের মুখে : “তিনি মঠের খাটা পায়খানা পরিষ্কার করেছেন–তা জানো? একদিন গিয়ে দেখেন খুব দুর্গন্ধ। বুঝতে আর বাকি কিছু রইল না। স্বামীজি গামছাটা একটু মুখে বেঁধে দু’হাতে দুটো বালতি নিয়ে যাচ্ছেন! তখন সবাই দেখতে পেয়ে ছুটে আসছে, বলছে, স্বামীজি আপনিস্বামীজির হাসি হাসি মুখ, বলছেন, এতক্ষণে স্বামীজি আপনি।”
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, স্থানীয় বালি মিউনিসিপ্যালিটি বেলুড় মঠকে বিদেশপ্রত্যাগত নরেন্দ্রনাথ দত্তের আমোদ-উদ্যান বলে নির্ধারিত করে মোটা ট্যাক্সো বসিয়ে দেন এবং এ নিয়ে শেষপর্যন্ত স্বামীজিকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। এই পর্বে মঠের পায়খানা পরিষ্কার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সমকালের কোনও অবিচার, অবজ্ঞা ও অপমান কিন্তু বিবেকানন্দকে স্পর্শ করতে, স্তব্ধ করতে, অথবা বিরক্ত করতে পারেনি। তার যত কিছু মান-অভিমান ও বকাবকি সব তার প্রিয় গুরুভাই ও শিষ্যদের প্রতি। শেষপর্বে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা সামলেছেন তার চিরবিশ্বস্ত সখা স্বামী ব্রহ্মানন্দ। যাঁর ডাকনাম রাখাল। স্বামীজি ছিলেন রাখালের থেকে নয়দিনের বড়। বিশ্বসংসারের সমস্ত আঘাত, আর সেইসঙ্গে রোগজর্জর শরীরের সমস্ত যন্ত্রণা নিঃশব্দে সহ্য করে, স্বামীজি বকতেন তার অতি প্রিয়জনদের, তাদের কাছে আশা করতেন পান থেকে চুন খসবে না, সবকিছু হয়ে উঠবে সর্বাঙ্গসুন্দর।
হরিমহারাজের স্মৃতি থেকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) আমরা জানতে পারি, স্বামীজি একদিন মঠ থেকে রেগে বেরিয়ে গেলেন। বললেন, “তোরা সব ছোটলোক, তোদের সঙ্গে থাকতে আছে! তোরা সব আলু-পটল শাক পাতা নিয়ে ঝগড়া করবি।”
বলাবাহুল্য রাগতেও যত সময় ঠাণ্ডা জল হয়ে যেতে তার থেকেও কম সময় নিতেন স্বামীজি। কিন্তু সন্ন্যাসীদের কাছে তার প্রত্যাশা ছিল সীমাহীন। “তোরা সব বুদ্ধিমান ছেলে, হেথায় এতদিন আসছিস। কী করলি বল দিকি? পরার্থে একটা জন্ম দিতে পারলি না? আবার জন্মে এসে বেদান্ত-ফেদান্ত পড়বি। এখন পরসেবায় দেহটা দিয়ে যা, তবে জানব আমার কাছে আসা সার্থক হয়েছে।”
রামকৃষ্ণ মঠের প্রথম অধ্যক্ষ রাজা মহারাজ (ব্রহ্মানন্দ) একবার বলেছিলেন, “স্বামীজিকে কে বুঝেছে, কে বুঝতে পারত? তাঁর বই পড়ে, তাকে বোঝা, আর তার কাছে থেকে তাকে বোঝা এক জিনিস নয়। তার কাছে থাকা, তাকে সহ্য করা যে কত কঠিন ছিল তা এরা জানে না। তার বকুনি সহ্য করতে না পেরে আমারই কতবার মনে হয়েছে মঠ ছেড়ে চলে যাই। একদিন বকুনি খেয়ে দুঃখে অভিমানে দরজা বন্ধ করে কাঁদছি, কিছুক্ষণ পরেই স্বামীজি দরজায় টোকা মারছেন, দরজা খুল্লম। চোখে জল দেখে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘রাজা, ঠাকুর তোমাকে কত আদর করতেন, ভালবাসতেন, সেই তোমাকেই আমি বকি, কত কটু কথা বলি, আমি আর তোমাদের কাছে থাকবার যোগ্য নই।
বলতে বলতে স্বামীজির চোখে জল ঝরছে, আমি তখন তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললাম, তুমি ভালবাস বলেই বকো, বুঝতে পারি না বলে অনেক সময় কান্না পায়।
স্বামীজি বলতে লাগলেন, আমি কী করব, আমার শরীরটা চব্বিশ ঘণ্টাই জ্বলছে, মাথার ঠিক থাকে না। আমি বেঁচে থাকলে তোমাদের হয়ত বৃথা কষ্ট দেব। দেখ রাজা, একটা কাজ করতে পারো? ওদের রেসিং হর্স যখন অকেজো হয়ে পড়ে তখন কী করে জানো? তাকে বন্দুকের গুলিতে মেরে ফেলে। আমি তোমাকে একটা রিভলবার জোগাড় করে দেব, তুমি আমাকে গুলি করে মারতে পারবে? আমাকে মারলে কোনও ক্ষতি হবে না, আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে।”
এই রাজা মহারাজ বেলুড়ে পাঁচটি চারা বাতাবি লেবু গাছ। লাগিয়েছিলেন, কারণ ডাক্তাররা বিবেকানন্দকে বাতাবি লেবু খেতে বলেছিলেন।
স্বামীজির শরীর থাকতে থাকতে কেবল গাছগুলিতে ফুল দেখা দিয়েছিল বলে পরবর্তী সময়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দ খুব দুঃখ করতেন। শোনা যায়, রাজা মহারাজকে স্বামীজি শেষের দিকে একবার বলেছিলেন, “এবার যা হয় একটা এপার ওপার করব, হয় শরীরটা ধ্যান, জপ করে সারিয়ে কাজে ভাল করে লাগব, না হয় তো এ ভাঙা শরীর ছেড়ে দেব।”
রোগজর্জরিত সিংহের আর এক মর্মস্পর্শী ছবি পাওয়া যায় স্বামী গম্ভীরানন্দর বর্ণনায়। “স্বাস্থ্য ভাল না থাকায় তিনি সবসময় নিচে নামিতে পারিতেন না–তখন শয্যাতেই শায়িত থাকিতেন–অসুখ কম থাকিলে তিনি নিচে নামিয়া ভ্রমণে বাহির হইতেন…কখনও কেবলমাত্র কৌপীনপরিহিত হইয়া মঠের চতুর্দিকে ভ্রমণ করিতেন, অথবা একটা সুদীর্ঘ আলখাল্লায় দেহ আবৃত করিয়া পল্লীর নিভৃত পথে একাকী বিচরণ করিতেন।…অনেক সময় রন্ধনশালায় গিয়া রন্ধনাদি পর্যবেক্ষণ করিতেন, অথবা স্বয়ং শখ করিয়া দুই-একটি উৎকৃষ্ট দ্রব্য প্রস্তুত করিতেন।”
এই পর্বে তিনি যে সামাজিক আদব-কায়দার ধার ধারতেন না তা এখন আমাদের অজানা নয়।
যেমন ইচ্ছা তেমন ঘুরে বেড়াতেন–”কখনও চটিপায়ে, কখনও খালি গায়ে, কখনও গেরুয়া পরিয়া, কখনও বা খালি কৌপীন আঁটিয়া, অনেক সময় হাতে থাকিত হুঁকা বা লাঠি।…তিনি থাকিতেন আপন নির্জন মানসভূমিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ।”
একাধিক স্মৃতিকথায় দেখা যাচ্ছে, শেষ দিকটায় স্বামীজি মানুষের সংস্রব একরকম ছেড়ে দিয়েছিলেন।