কিন্তু দুঃসময় তো সুদূর নয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা দেখছি, বারাণসীতেও তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তিনজন সেবক পালা করে সারারাত বিনিদ্র বিবেকানন্দকে হাত পাখার হাওয়া করছেন।
স্বামীজি বারাণসী থেকেই নিবেদিতাকে লিখছেন : বসতে পর্যন্ত পারছি না। সবসময় ঘুসঘুসে জ্বর, সেই সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। কয়েকদিন পরে পা এমন ফুলে ওঠে যে হাঁটতে পারছেন না।
জীবনের শেষ কয়েক মাস স্বামীজির রোগজীর্ণ শরীরকে কেন্দ্র করে অনেক ডাক্তারি হয়েছে।
অন্যতম চিন্তার কারণ শোথ বা ড্রপসি। কবিরাজ মহানন্দ সেনগুপ্ত এলেন। তার নির্দেশ, কয়েক সপ্তাহ জল ও নুন একেবারেই খাওয়া চলবে না। প্রতিজ্ঞা করলেন বিবেকানন্দ, তাই হবে। কী অসীম মনোবল থেকে এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা যায়, তা আমাদের মতন মানুষের চিন্তার বাইরে। তরল পদার্থের মধ্যে একটু দুধ। এমন দুর্জয় মনোবল যে মুখে জল দিয়ে মুখ কুলকুচি করছেন কিন্তু এক বিন্দু তৃষ্ণার জল গলা দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। শুধু কবিরাজী নয়, প্রিয় গুরুভাইরা বড় বড় অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের কাছেও ছুটছে। একজনের নাম পাওয়া যাচ্ছে–ডাক্তার সন্ডার্স।
মহাসমাধির কয়েকদিন আগে হাওয়া বদলাতে স্বামীজি কলকাতার কাছে বড় জাগুলিয়া গিয়েছিলেন প্রথমে ট্রেনে, পরে গোরুর গাড়িতে সাত মাইল। আনন্দিত বিবেকানন্দ তার চিঠিতে লিখলেন, এমন ধকলের পরেও ড্রপসি ফিরে এল না, পা ফুলল না।
এরই মধ্যে নানা চিন্তায় বিপন্ন এবং বিব্রত আমাদের বিবেকানন্দ। অর্থাভাব। নিবেদিতার কাছে চিঠি, ইউরোপ থেকে সামান্য যে অর্থ নিয়ে এসেছিলাম তা মায়ের অন্নসংস্থান ও দেনা শোধে খরচ হয়ে গিয়েছে। সামান্য যা পড়ে আছে তা আমি স্পর্শ করতে পারব না, কারণ আত্মীয়দের সঙ্গে পৈত্রিক বাড়ির মামলায় খরচ যোগাতে হবে।
এই সময় গুরুভাই রামকৃষ্ণানন্দ মাদ্রাজ থেকে স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে এসে, অবাক কাণ্ড করলেন। তার সারাজীবনের ব্যক্তিগত সঞ্চয় ৪০০ টাকা জোর করে তার প্রিয় গুরুভাইকে দিয়ে গেলেন। বিবেকানন্দ বিমোহিত–এমন ভালবাসা কে কোথায় দেখেছে? সেই টাকা গ্রহণ করলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিবেদিতাকে লিখলেন, ওই টাকা আমি মঠে রেখে দিয়েছি। যদি হঠাৎ আমার দেহাবসান হয় তা হলে অবশ্যই দেখো ওই টাকা যার সে যেন ফেরত পায়।
প্রায় এক বছর রাত্রে স্বামীজির চোখে ঘুম নেই। বিনিদ্র বিবেকানন্দর শরীর তখন এমন যে অসাবধানে স্পর্শ করলেও প্রবল যন্ত্রণা হয়। প্রিয় শিষ্যকে স্বামীজি বললেন, “আর কেন শরীর সম্পর্কে প্রশ্ন? প্রতিদিন দেহটা আরও বিকল হয়ে যাচ্ছে। বাংলায় জন্মে, এই শরীরটা কোনও দিনই অসুখ থেকে মুক্ত ছিল না। স্বাস্থ্যের পক্ষে এই প্রদেশটা মোটেই ভাল নয়। একটু বেশি পরিশ্রম করতে চাইলেই, চাপ সহ্য করতে না পেরে দেহটা ভেঙে পড়ে।”
কাজ করতে করতে চলে যেতে চান কর্মযোগী বিবেকানন্দ। কুঁড়েমি করে বসে থাকার জন্যে তো এই মানব শরীরের সৃষ্টি হয়নি।
শেষ পর্বে স্বামীজির রোগের তালিকায় নতুন সংযোজন উদরী, অর্থাৎ পেটে জল হওয়া। তিরোধানের কিছু আগে রোগাক্রান্ত, বিনিদ্র, ধৈর্যচ্যুত, তিতিবিরক্ত যে বিবেকানন্দকে আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রায়ই প্রিয়জনদের এমন বকাবকি করেন যে তাদের চোখে জল পড়ে।
*
আমরা আগেই দেখেছি, স্বামীজির অন্যতম সমস্যা ছিল বিনিদ্রা। ঈশ্বর এই মানুষটির চোখে ঘুম দিতে চাইতেন না, ফলে প্রায়ই সারারাত ধরে চলত নিদ্রাদেবীর চরণে হৃদয়বিদারী সাধাসাধি।
স্বামী অখণ্ডানন্দ লিখেছেন, “বেলুড়ে তখনও রাত আছে, উঠে পড়েছি, উঠেই স্বামীজিকে দেখতে ইচ্ছে হল। স্বামীজির ঘরে গিয়ে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছি, ভেবেছি স্বামীজি ঘুমোচ্ছেন, উত্তর না আসলে আর জাগাবো না। স্বামীজি কিন্তু জেগে আছেন–ঐটুকু টোকাতেই উত্তর আসছে গানের সুরেনকিং নকিং হু ইজ দেয়ার? ওয়েটিং ওয়েটিং ও ব্রাদার ডিয়ার।”
মঠে এমন দিনও গিয়েছে যে আলোচনা করতে গিয়ে রাত দুটো বেজে গিয়েছে, স্বামীজি বিছানায় শোননি, চেয়ারে বসেই রাতটা কাটিয়েছেন। একবার নীলাম্বর মুখুজ্যের বাগানে নানাবিষয়ে রাত দুটো পর্যন্ত সন্ন্যাসীদের প্রাণবন্ত আলোচনা চললো। চারটে না বাজতেই অখণ্ডানন্দকে স্বামীজি সবাইকে তুলে দিতে বললেন–”লাগা ঘণ্টা, সব উঠুক, শুয়ে থাকা আর দেখতে পারছি না।”
অখণ্ডানন্দ বললেন, “এই দুটোর সময় শুয়েছে, ঘুমোক না একটু।”
স্বামীজি : “কি দুটোর সময় শুয়েছে বলে ছ’টার সময় উঠতে হবে নাকি? দাও আমাকে, আমি ঘণ্টা দিচ্ছি–আমি থাকতেই এই! ঘুমোবার জন্য মঠ হল না কি?”
বিনিদ্র বিবেকানন্দ সম্বন্ধে এত কথা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে তা ধৈর্য ধরে সংগ্রহ করতে পারলে বোঝা যাবে মানুষটা জীবনের প্রতি মুহূর্তে কত কষ্ট সহ্য করেছেন, কিন্তু কিছুতেই পরাজয় মেনে নিতে চাননি। যে ৪ জুলাই (১৯০২) তার মহাসমাধি হলো, সেদিনও তিনি দিবানিদ্রার নিন্দা করলেন। সাধুদের বলেন, বললেন, “তোরা ঘুমোবি বলে মঠ হল নাকি?”
স্বামীজিকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে স্বামী অখণ্ডান মন্তব্য করেছেন, স্বামীজি কখনও রাগতেন না, তবে বকাবকি করতেন খুব। পান থেকে চুন খসবার উপায় ছিল না। যার উপর তার যত বিশ্বাস, যে যত আপনজন সে তত বেশি বকুনি খেত তাঁর কাছ থেকে। অন্তলীলা পর্বে এই বকুনির পরিমাণ বেশ বেড়ে গিয়েছিল, কারণ তিনি চাইছিলেন এমন এক মঠজীবন তৈরি করে যাবেন যার কোনও তুলনা থাকবে না। শুধু অধ্যাত্মজীবন ও শাস্ত্ৰপঠন নয়, মঠের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও হবে ত্রুটিহীন। তাই বিশ্ববিজয় করে বেলুড়ে ফিরে এসেও তিনি মঠের বড় বড় হান্ডা মেজেছিলেন–এক ইঞ্চি পুরু ময়লা।