পরের বছরে (১৯০২) জানুয়ারির শেষে আবার পথের ডাক। এবার জাপানিদের সঙ্গে বোধগয়ায়, সেখান থেকে পরের মাসে ট্রেনে বারাণসী। চলার শেষ টানতে রাজি নন সন্ন্যাসী, শরীর অশক্ত হলেও কী আসে যায়? মন তো আছে।
অনুসন্ধিৎসুরা এইসব ভ্রমণ বৃত্তান্তর বিবরণ যথাস্থানে পড়ে নিতে এখন আমাদের সময় নেই, আমাদের সামনে সেই দুঃখময় শুক্রবার ৪ জুলাই। মোদ্দা কথা, পাখি তার শেষ আশ্রয় বেলুড় মঠে ফিরে এসেছে–হয় ৭ মার্চ ১৯০২ অথবা পরের দিন,দু’জন শ্রদ্ধেয় মানুষ দু’রকম তারিখ লিখে রেখে গিয়েছেন। পণ্ডিতরা বিবাদ করুন লয়ে তারিখ সাল, আমরা বরং খোঁজ করি স্বামীজির শরীর স্বাস্থ্যের।
শেষ পর্বে নিজের শরীরের কথা কর্তা স্বয়ং প্রায় নিয়মিতভাবেই লিখে গিয়েছেন তার প্রিয় শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে। এই চিঠিগুলি সম্প্রতি প্রকাশিত ইংরিজি রচনাবলির নবম খণ্ডে স্থান করে দিয়েছেন পরম নিষ্ঠাবান ও সাবধানী প্রকাশক অদ্বৈত আশ্রম।
.
এইসব চিঠিতে আমাদের প্রিয় বিবেকানন্দ নিরন্তর আশা-নিরাশার দোলায় দুলছেন। কখনও লিখছেন, খুব ভাল ঘুম হচ্ছে, জেনারেল হেথ মোটেই খারাপ নয়। আবার কখনও লিখছেন, বঙ্গজননী আমাকে মাঝে মাঝে হাঁপানি উপহার দেন, কিন্তু হাঁপানি এবার পোষ মানছে। তবে সর্বনাশা রোগ ডায়াবিটিস ও ব্রাইটস ডিজিজ একেবারেই উধাও।
দ্বিতীয় অসুখটি কিডনি সংক্রান্ত, ডায়াবিটিস অনেক সময় একে সঙ্গে নিয়ে আসে, সাধারণ ভাষায় বোধ হয় নেফ্রাইটিস। শুকনো জায়গায় গেলে হাঁপানি যে ঠিক হয়ে যাবে, সে বিষয়ে মহানায়ক বিবেকানন্দ সুনিশ্চিত। কিন্তু রোগের ধাক্কা যখন আসে তখন শরীর আধখানা করে দিয়ে যায়। “তবে আবার শরীরে একটু মেদ জড়ো করতে আমার সময় লাগে না,” আশ্বস্ত করছেন বিবেকানন্দ তাঁর এক মানসকন্যাকে।
আরও একটি চিঠিতে দারুণ গরমে ঘামাচির বিরুদ্ধে সরস মন্তব্য করেছেন স্বামীজি। শরীরের নানা অংশে দগদগে ঘামাচি–আর সেই সঙ্গে তিক্ত মেজাজ। নার্ভ উত্যক্ত, বুঝছেন বিবেকানন্দ, স্বীকার করছেন মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুত হয়ে এতই রাগারাগি করছেন যে একজনকেও কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছেন না যে ধৈর্যময় হয়ে তাকে সহ্য করবে। কিন্তু এবার তিনি রাগ কমিয়ে ফেলতে কৃতসংকল্প, “দেখো, এবার আমি ভেড়ার মতন শান্ত হয়ে উঠবো।”
অক্টোবরের চিঠিতে গরমের বিরুদ্ধে স্বামীজির প্রবল অভিযোগ– আমার গায়ের রঙ এখন কালা আদমিদের থেকেও কালো! স্বামীজির শারীরিক লক্ষণ বিচার করে, খ্যাতনামা চিকিৎসক ডাক্তার সুব্রত সেন আমাকে বললেন, “ব্যাপারটা সুবিধের নয়, কারণ ওটা রেনাল ফেলিওরের লক্ষণও হতে পারে।” ঐতিহাসিক পুরুষদের শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে নতুন বৈজ্ঞানিক আলোকপাতের চেষ্টা ইদানীং দেশে দেশে চালু হয়েছে, আমরা অবশ্য একেবারেই পিছিয়ে আছি।
নভেম্বরে সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখছেন, দুর্গাপূজার সময় থেকে শরীরটা মোটেই ভাল নয়। একই দিনে সিস্টার ক্রিশ্চিনকে আর একখানা চিঠি– কয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতা এবং বাংলা ছাড়তেই হবে বর্ষার পরেই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ভীষণ বেড়ে যায়। এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন, বেলুড়ে পোষা জন্তু জানোয়ার পাখিদের সঙ্গে তার শিশুসুলভ আনন্দময় জীবনের কথা। মজার মন্তব্য আছে, “আমার চিড়িয়াখানায় মুরগি নেই, ওই জীব এখানে নিষিদ্ধ!”
নভেম্বরের শেষে পরপর দুটি খারাপ খবর “ডান চোখটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।” (মনে হয় ডায়াবিটিসের ফল।) বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন কিনা জানি না, তবে লোকে তাকে বলছে কলকাতায় গিয়ে চোখের ডাক্তার দেখাও। স্বামীজি অবশ্যই যাবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে সর্দিতে তিনি বিছানাবন্দী। স্বামীজির পরের চিঠিতে সর্দিকাশির সঙ্গে হাঁপানির পুনরাবির্ভাব ঘোষণা।
দুসপ্তাহ পরে বিবেকানন্দ নিজেই শরীর সম্বন্ধে আরও খারাপ খবর দিচ্ছেন শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে তিন বছর ধরে তিনি অ্যালবুমিন-ইউরিয়ায় জর্জরিত। মাঝে মাঝে প্রবল ধাক্কা আসে, আবার চলে যায়–তবে কিডনি বোধহয় সুস্থ আছে। বিবেকানন্দ নিজেই ব্যাখ্যা করছেন, ডায়াবিটিস থেকেও খারাপ এই অ্যালবুমিন, রক্ত বিষাক্ত হয়, হার্ট আক্রমণ করে এবং আরও নানারকম বিপদ ঘটায়। সর্দি হলে এর প্রকোপ বেড়ে যায়। এবার আমার ডান চোখটায় ব্লাড ভেসেল ফাটিয়ে দিয়েছে, ফলে আমি প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।…
ডাক্তাররা একসময় আমাদের বিবেকানন্দকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন। মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ, হাঁটাচলা এমনকি দাঁড়িয়ে থাকাও বারণ। এখানে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ইঙ্গিত আছে, কবিরাজরা টন টন সোনাচাদি এবং মুক্তা গিলতে বাধ্য করছেন রোগীকে।
এইভাবে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ এসে গেল। আশানিরাশার দোলায় দুলছে পত্রলেখক বিবেকানন্দ। কখনও বলছেন, ঘুম হচ্ছে, কোনো অসুবিধা নেই, একটু বিশ্রাম নিলেই দুরাত্মা ডায়াবিটিস ও অ্যালবুমিন দূর হয়ে যাবে। কখনও লিখছেন, সম্ভব হলে ভাল আমলকী পাঠাও, কলকাতার আমলকী সুবিধের নয়। ক্রিশ্চিনকে লেখা স্বামীজির শেষ চিঠি : আমার সম্বন্ধে একটুও উদ্বিগ্ন হয়ো না। সেই সঙ্গে সুখবর, শরীর ইদানীং এতই ভাল যে শীর্ণতা কাটিয়ে মধ্যপ্রদেশে একটু ভুঁড়ির ইঙ্গিতও দেখা যাচ্ছে!