কিন্তু ধারাবাহিকতায় ফেরা যাক এবার। আমাদের স্বামীজিকে নিয়ে ইতালীয় জাহাজ রুবাত্তিনোবোম্বাই বন্দরে পৌঁছে গিয়েছে।
রুবাত্তিনো হয় ৬ অথবা ৭ ডিসেম্বর ১৯০০ বোম্বাই বন্দরে ফিরেছিল আমাদের স্বামীজিকে নিয়ে। শেষ হলো তার বিদেশ ভ্রমণপর্ব। হাওড়াগামী ট্রেনের জন্য স্বামীজিকে স্টেশনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
ট্রেনে দৈবক্রমে পূর্বপরিচিত বন্ধু মন্মথনাথ ভট্টাচার্যর সঙ্গে স্বামীজির দেখা হয়ে গিয়েছিল। বিদেশি পোশাকে সজ্জিত স্বামীজিকে তিনি প্রথমে চিনতেই পারেননি, পরে দু’জনে খুব আমোদ-আহ্লাদ হয়েছিল।
বম্বে-হাওড়া এক্সপ্রেসে স্বামীজি একা হাওড়া স্টেশনে নামলেন, ওখান থেকে সন্ধ্যায় গাড়িভাড়া করে আচমকা বেলুড়ে আগমন। সে এক মধুর প্রত্যাবর্তন–আমরা জানি ডিনারের ঘণ্টা শুনে, গেটের তালা খোলার জন্যে অপেক্ষা না করে সায়েবী সাজসজ্জায় যে মানুষটি মালপত্তর সমেত দেওয়াল টপকে ভোজনের আসরে সানন্দে বসে পড়ে প্রাণভরে প্রিয় খিচুড়ি খেয়েছিলেন রবিবার ৯ ডিসেম্বর ১৯০০র সন্ধ্যায়, সে মানুষটির মধ্যে গুরুভাইরা গুরুতর অসুস্থতার কোনও ইঙ্গিত লক্ষ্য করেননি।
স্বয়ং বিবেকানন্দও তখন প্রবলভাবে সহাস্য। বেলুড়ের সবাইকে তিনি বলছেন, “তোদের খাবার ঘণ্টা শুনেই ভাবলুম, এই যাঃ, এখনি না গেলে হয়তো সব সাবাড় হয়ে যাবে, তাই দেরি করলাম না।”
.
কিন্তু পত্রাবলীর আলোকে এতদিন পরে পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখলে শরীর সম্পর্কে কিছু কিছু অস্বস্তিকর ইঙ্গিত ছ’মাস আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। জুন মাসে বিবেকানন্দ তাঁর চিঠিতে বদহজম ও ডিসপেপসিয়া নিয়ে রসিকতা করছে। প্রায় একই সময় স্নেহের ক্রিশ্চিনকে স্বামীজি লিখেছেন নিউইয়র্ক থেকে, “কিডনির অসুখের ভয়টা কেটে গেছে, এখন দুশ্চিন্তাই আমার প্রধান অসুখ, এই রোগটাও আমি দ্রুত জয় করার চেষ্টা চালাচ্ছি।” কিন্তু দু’মাস পরেই আগস্ট মাসে মার্কিন অনুরাগী জন ফক্সকে স্বামীজি জানাচ্ছেন, “আমার শরীর দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। মহিমকে (ভাই) মাকে এবং সংসারকে দেখার ভার নেবার জন্যে তৈরি হতে হবে। আমি যে কোনও সময়ে চলে যেতে পারি।”
স্বদেশে আচমকা ফিরে এসে, বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী ভাইদের সঙ্গে হৈহৈ করে খিচুড়ি খাওয়ার আনন্দে বিভোর বিবেকানন্দ তার প্রিয় খেতড়ির নরেশকে লিখছেন : “আমার হার্ট খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে।…আমার মনে হচ্ছে, এজীবনে যা করার ছিল তা শেষ হয়েছে। এর আগে প্যারিস থেকে (আগস্ট ১৯০০) প্রিয় হরিভাইকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) স্বামীজি লিখছেন, “আমার কাজ আমি করে দিয়েছি বস্। গুরু মহারাজের কাছে ঋণী ছিলাম–প্রাণ বার করে আমি শোধ দিয়েছি। সে কথা তোমায় কি বলব?..দলিল করে পাঠিয়েছি সর্বেসর্বা কত্তাত্তির। কত্তাত্তি ছাড়া বাকী সব সই করে দিয়েছি।”
*
জীবন নাটকের যবনিকাপাতের সত্যিই আর দেরি নেই, আর মাত্র আঠারো মাস। কিন্তু পায়ের তলায় সরষে নিয়ে যাঁদের জন্ম তারা ভগ্নশরীরেও ঘুরে বেড়াতে চান চরকির মতন।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা দেখছি বিবেকানন্দকে মায়াবতী আলমোড়ার পথে। কাঠগোদামে স্বামীজির জ্বর জ্বর ভাব। সেখানে একদিন বিশ্রাম করলেন। মায়াবতীতে পৌঁছে শিষ্য বিরজানন্দকে বলছেন, “শরীরটাকে বেজায় কষ্ট দিয়েছি, তার ফল হয়েছে কি?না জীবনের যেটা সবচেয়ে ভাল সময় সেখানটায় শরীর গেল ভেঙে। আর আজ পর্যন্ত তার ঠেলা সামলাচ্ছি।”
১৯০১ জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বেলুড়ে ফিরে মিসেস ওলি বুলকে পরমানন্দে স্বামীজি জানাচ্ছেন, “বাংলাদেশে, বিশেষত মঠে যে মুহূর্তে পদার্পণ করি, তখনি আমার হাঁপানির কষ্টটা ফিরে আসে, এস্থান ছাড়লেই আবার সুস্থ। আগামী সপ্তাহে আমার মাকে নিয়ে তীর্থে যাচ্ছি…তীর্থদর্শন হলো হিন্দু বিধবার প্রাণের সাধ; সারাজীবন সব আত্মীয়স্বজনদের কেবল দুঃখ দিয়েছি। তাদের এই একটি ইচ্ছা অন্তত পূর্ণ করতে চেষ্টা করছি।”
এর আগে মায়াবতী থেকে ধীরামাতা মিসেস বুলকে (৬ জানুয়ারি ১৯০১) স্বামীজি লিখেছেন, “কলকাতায় প্রথম দিনের ছোঁয়াতেই আমার হাঁপানি আবার দেখা দিয়েছিল। সেখানে যে দু-সপ্তাহ ছিলাম প্রতি রাত্রেই রোগের আক্রমণ হত।”
মার্চের শেষে অসুস্থতার তোয়াক্কা না করে ঢাকা চললেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেখান থেকে চট্টগ্রাম, কামরূপ, কামাখ্যা এবং শিলং।
হাঁপানিও যে স্বামীজির সঙ্গের সাথী তার প্রমাণ অনেক রয়েছে। ঢাকায় এক বারাঙ্গনা করুণভাবে তার কাছে নিবেদন করল, সে হাঁপানিতে ভুগছে, স্বামীজির কাছে সে ওষুধ ভিক্ষা চাইছে। অসহায় স্বামীজি সস্নেহে বললেন, “এই দেখ, মা! আমি নিজেই হাঁপানির যন্ত্রণায় অস্থির, কিছুই করতে পারছি না। যদি আরোগ্য করবার ক্ষমতা থাকতো, তা হলে কি আর এই দশা হয়!”
ঢাকাতে স্বামীজির ডায়াবিটিসও বেড়েছিল। গৌহাটিতে হাঁপানি বাড়ে, আর শিলং-এ তো খুব খারাপ অবস্থা। যখন হাঁপানির টান বাড়ত তখন কতকগুলো বালিশ একত্র করে বুকের ওপর ঠেসে ধরতেন এবং সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতেন। শিলং-এ অ্যালবুমেন। বেড়েছিল এবং শরীর দ্বিগুণ ফুলে গিয়েছিল।
কিন্তু বেলুড় মঠে ফিরতেই স্বামীজির রোগের প্রকোপ কমে গেল। এই সময়কার চিঠিতে বাংলার পাহাড়ের মৃদু নিন্দা করেছেন আমাদের পরমপ্রিয় সন্ন্যাসী। জোসেফিন ম্যাকলাউডকে স্বামীজি লিখছেন, “আমাদের পার্বত্যস্বাস্থ্যনিবাস শিলং-এ আমার জ্বর, হাঁপানি ও অ্যালবুমেন বেড়েছিল এবং শরীর দ্বিগুণ ফুলে গিয়েছিল। যাহোক, মঠে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে রোগের লক্ষণগুলি হ্রাস পেয়েছে।” শিলং-এ চিফ কমিশনার স্যর হেনরি কটন স্থানীয় সিভিল সার্জনকে তার চিকিৎসার ভার নিতে বলেছিলেন এবং দু’বেলা নিজে খবর নিতেন।