অসীম শারীরিক শক্তি নিয়েই নরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাসের দুর্গম পথে যাত্রা করেছিলেন। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, অনেকেরই ধারণা স্বামীজির অনেক অসুখবিসুখই শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর বরানগরের কঠিন দারিদ্র্য ও পরিব্রাজক জীবনে ভিক্ষান্নে ভোজনং যত্রতত্র এবং শয়নং হট্টমন্দির থেকে উদ্ভূত। এ-বিষয়ে অবশ্যই আরও অনুসন্ধানের প্রয়োজন থেকে গেল। কিন্তু সেই সঙ্গে সিমুলিয়ার দত্তদের পারিবারিক অসুখবিসুখগুলোর দিকে নজর দেওয়াটাও প্রয়োজন।
আমরা বিবেকানন্দর ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানতে পারি, পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত অল্পবয়সেই ডায়াবিটিসের রোগী হন। এই রোগ পরবর্তী সময়ে শুধু নরেন্দ্রনাথকে নয়, তার অন্য দুই ভাই মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথকেও আক্রমণ করে। মহেন্দ্র ও ভূপেন্দ্র অবশ্য দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের অন্তরঙ্গ শ্রী রঞ্জিত সাহার কাছে শুনেছি, ভূপেনবাবু মিষ্টি এড়িয়ে চলতেন। দু’জনেরই হাইপারটেনশন ছিল, যা নরেন্দ্রনাথের মধ্যেও অল্পবয়স থেকে থাকতে পারে। কারণ কম বয়সেও মাথার যন্ত্রণার উল্লেখ রয়েছে পারিবারিক স্মৃতিতে।
আরও বলা যাক। স্বামীজির পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত বাহান্ন বছর পেরোননি। মৃত্যুর মাসখানেক আগে তার হার্টের রোগ হয়েছিল। বহু বছর পরে ৫ জুলাই ভোরবেলায় যখন উত্তর কলকাতার বাড়িতে স্বামীজির দেহরক্ষার সংবাদ এল তখন শোকবিহ্বলা জননী জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ কী হল? তখন কনিষ্ঠ পুত্র বললেন, “বাবার যা হয়েছিল।” পিতার মৃত্যুও রাত ন’টা নাগাদ, খাবার পরে বাঁ হাতে তামাক খাচ্ছিলেন, বমি করলেন, তারপরেই হৃদযন্ত্র বন্ধ।
কৌপীনধারী অবস্থায় ভিক্ষান্নে জীবন অতিবাহিত করে নরেন্দ্রনাথের শরীরে বেশ কয়েকটি রোগের আবির্ভাব বা সূত্রপাত হয়েছিল একথা আমরা আগেই জেনেছি।
সন্ন্যাসজীবনে পেটের অসুখ নিত্যসাথী হওয়ায় সদা চলমান সন্ন্যাসীর খুবই অসুবিধা হয়েছিল। বারবার টয়লেটে ছোটার তাগিদে, ট্রেনের নিচু ক্লাসে ভ্রমণ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ছাত্রাবস্থায় আমাদের ইস্কুলে বারবার শুনেছি, পরিব্রাজক সন্ন্যাসীকে দয়াপরবশ হয়ে কেউ কেউ ট্রেনের টিকিট কেটে দিতে চাইলে, নরেন্দ্রনাথ তাকে তখনকার উচ্চশ্রেণীর (সেকেন্ড ক্লাস) টিকিট দিতে অনুরোধ করতেন।
এই পেটের গোলমালের জন্য একবার এদেশের মহা উপকার হয়েছিল। এমন দাবিও অন্যায় হবে না! প্রথমবার আমেরিকা যাবার সময় কম খরচে ডেকের যাত্রী হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। খেতড়ির মহারাজা তাঁকে জাহাজের ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কিনে না দিলে সে যাত্রায় তাঁর সঙ্গে টাটা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজী টাটার পরিচয় হত না।
টাটা দেশলাই আমদানির জন্য জাপানে গিয়েছিলেন। ধনপতি ব্যবসায়ীকে কাছে পেয়ে স্বামীজি তাঁকে স্বদেশে শিল্প স্থাপন করার অনুপ্রেরণা দেন এবং সেই সঙ্গে স্বদেশে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। জামশেদজী পরবর্তীকালে টাটা স্টিল ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসেন। টাটা-বিবেকানন্দ পত্রাবলীর পুনর্সন্ধান করে সাম্প্রতিক গবেষকরা এদেশের মানুষের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।
মার্কিন দেশের সংগ্রাম ও রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠা বিবেকানন্দের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মার্কিন গবেষকদের দয়ায় আমাদের হাতের গোড়ায় রয়েছে। সেখানে তাঁর অসুখবিসুখ এবং খাওয়াদাওয়া সম্পর্কেও যথেষ্ট খবরাখবর রয়েছে। আমরা দেখেছি তার স্মোকিং বেড়েছে; নতুন আকর্ষণ নবাবিষ্কৃত আমেরিকান আইসক্রিম। আধুনিক চিকিৎসা এবং আজব চিকিৎসা দুটোর কাছেই তিনি আত্মসমর্পণ করেন, তবে অমানুষিক পরিশ্রমের মতন শরীর তখনও তার রয়েছে।
বহুদিন পরে জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থ স্বামীজিকে একজন অনুরাগী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্বামীজি, আপনার শরীর এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল, আগে যত্ন নেননি কেন?” স্বামীজি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমেরিকায় আমার শরীরবোধই ছিল না।”
তা হলে প্রথম বড় অসুখের ইঙ্গিত আমরা কোথায় পেলাম? বিশ্বাসযোগ্য উপাদান রয়েছে ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তর লেখায়। ১৮৯৬ সালে আমেরিকা থেকে দ্বিতীয়বার ইংলন্ডে এসেছেন বিবেকানন্দ।
এই পর্বেই কিন্তু বড় আকারের দুঃসংবাদের ইঙ্গিত। লন্ডনেই আমরা প্রথম স্বামীজির হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়েছি। লন্ডনে একদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পর স্বামীজি বসে ভাবছিলেন। সামনে আমেরিকান অনুরাগী জন পিয়ার ফক্স ও মহেন্দ্রনাথ।
মহেন্দ্রনাথের বর্ণনা অনুযায়ী “হঠাৎ যেন তাঁহার মুখে বড় কষ্টের ভাব দেখা গেল। খানিকক্ষণ পরে তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া ফক্সকে বলিলেন, দেখ ফক্স, আমার প্রায় হার্ট ফেল করছিল। আমার বাবা এই রোগে মারা গেছেন, বুকটায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছিল, এইটা আমাদের বংশের রোগ।” অর্থাৎ তেত্রিশ বছর বয়সেই অকাল দেহাবসানের সুনিশ্চিত ইঙ্গিত।
এখন প্রশ্ন, পরবর্তী সময়ে স্বামীজির হার্টের অবস্থা কেমন ছিল? ১৮৯৮ সালে অমরনাথ তীর্থ দর্শনের সময় আবার একটা অস্বস্তিকর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। পাহাড়-ভাঙার অবর্ণনীয় ধকলের পরে ডাক্তার বলছেন, ওঁর হৃদয়যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারত। চিকিৎসকের সাবধানবাণী, স্বামীজির হার্টের আকার বিপজ্জনকভাবে বড় হয়ে গিয়েছে। বেলুড়ে ফেরার কয়েকদিন পরে স্বামী-শিষ্য সংবাদের স্মরণীয় লেখক শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে যখন স্বামীজির দেখা, তখন তাঁর বাঁ চোখের ভিতরটা লাল হয়ে রয়েছে। আর ডাক্তারদের সাবধানবাণী : ওই চোখে ব্লাড ক্লট হয়েছে। শেষপর্বে আমরা দেখছি, তার ডান চোখটিও নষ্ট হয়ে গেছে, অর্থাৎ জীবন দীর্ঘতর হলে সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হওয়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। মানুষটি কিন্তু এমনই রসিক যে নিজেকে একচক্ষু শুক্রাচার্যের সঙ্গে তুলনা করেও আনন্দ পাচ্ছেন!