বিবেকানন্দর চোখ এবার জলে ভরে উঠলো। মাদাম কালভের ভাষায়, এরপর তিনি বললেন, “আমি দেশে ফিরতে চাই, মরবার জন্য, আমার গুরুভাইদের কাছে যেতে চাই আমি।”
কালভে বললেন, “আপনাকে আমরা মরতে দিতে পারি না, আমাদের প্রয়োজন আপনাকে।”
তারপরেই বিস্ফোরণ! কালভেকে স্বামীজি জানালেন, ৪ঠা জুলাই আমার মৃত্যু হবে।
২৬ নভেম্বর ১৯০০ স্বামীজি মিশর থেকে বোম্বাই বন্দরের উদ্দেশে রুবাত্তিনো জাহাজে চড়লেন একাকী।
তিনদিন পরে মিস ম্যাকলাউডের চিঠি তাঁর বান্ধবী সারাকে: “স্বামীজির খবর ভাল নয়। তার আর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল–এখন ভারতে ফিরে যাচ্ছেন।”
আমাদের প্রশ্ন : “আর একটা কথার মানে কি দ্বিতীয় আক্রমণ? সেক্ষেত্রে বেলুড়ে ৪ জুলাই ১৯০২ সন্ধ্যায় তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকেই কি তাঁর মতলীলার অবসান?
বিদেশিনী গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাককে তেমন গুরুত্ব দিতে পারছেন না। কারণ মিশর ভ্রমণপর্বে তাকে কখনও প্রচণ্ড অসুস্থ দেখায়নি।
৫. উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন
শেষ পর্বের শুরু এবার। আশঙ্কিত হৃদয় নিয়ে আমরা চলেছি ৪ জুলাই ১৯০২-এর দিকে।
কিন্তু এ দেশের সনাতন চিন্তাধারায় স্মরণীয় মানুষদের তিরোধান দিবস সম্পর্কে আমাদের বিশেষ উৎসাহ নেই।
“আবির্ভাব নিয়েই আমাদের আনন্দোৎসব, মৃত্যু সে তো বাসাংসি জীর্ণানি, পুরনো বস্ত্র ছেড়ে নতুনে চলে যাওয়া”, আমাকে বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত মঠ ও মিশনের এক প্রবীণ শ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসী। এর অর্থ, ৪ জুলাই ২০০২ যে বীরসন্ন্যাসী বিবেকানন্দর তিরোধান দিবস নিয়ে তেমন ব্যস্ততা নেই তাদের মধ্যে, যাঁরা শতবর্ষের বেশি সময় ধরে এই মহাপুরুষের বাণীকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবু এদেশের সংখ্যাহীন মানুষের মনে ৪ জুলাই নাড়া দিয়ে যায়, আজও মনে প্রশ্ন ওঠে, যে অলৌকিক শরীরের তিরোধান ঘটেছিল ১৯০২ সালে, সেই শরীর যদি ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিনের বেশি স্থায়ী হত, তা হলে এদেশের ভাগ্যাকাশে আরও কী কী পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত? আমরা জগৎবাসীরা আরও কী কী উপহার পেতে পারতাম সেই অমৃতপুত্রের কাছ থেকে?
একথাও সত্য যে এই পৃথিবীতে ঈশ্বরপুত্ররা প্রায়ই দীর্ঘজীবী হননি খ্রিস্ট ও শঙ্করাচার্যের সংক্ষিপ্ত জীবনের কথা তো আমাদের অজানা নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে ভগবান বুদ্ধও তো আছেন। একজন বিদেশিনী তো সস্নেহে বিদগ্ধ বিবেকানন্দকেও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, বুদ্ধ তো চল্লিশ বছর থেকে আশি বছর পর্যন্ত বিশ্বসংসারকে কম সেবা করেননি।
স্মরণীয় দিনে মৃত্যুকে এই যে উপেক্ষা, বিশেষ করে মহামানবদের তিরোধান, তারই পিছনে সত্যিই কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কিনা তার প্রারম্ভিক অনুসন্ধান করতে গিয়েই এই অধ্যায়ের সূচনা।
কিন্তু সেই সঙ্গে অন্য কিছু প্রসঙ্গও এসে পড়ে, আর স্মরণে আসে–যাঁকে নিয়ে এই অনুসন্ধান তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন : “চিন্তা করো, উপাদান সংগ্রহ করো, সমস্ত অলৌকিকত্ব বাদ দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের একটা জীবনী রচনা করো।” অর্থাৎ অলৌকিকত্ব থাকলেও তা নিয়ে বিভোর হওয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি ইচ্ছে করেই এসেছিলেন অতি অল্পদিনের জন্য এবং ইচ্ছা করেই বিবেকানন্দ অতি অল্প সময়ের মধ্যে চলে গিয়েছেন, এসব সত্য হলেও, পৃথিবীর অন্য মহাপুরুষদের প্রদর্শিত পথেই করতে হবে তাঁর অনুধ্যান।
বিবেকানন্দ বিষয়ের চলমান বিশ্বকোষ শঙ্করীপ্রসাদ বসু মহাশয় আমাকে উৎসাহ দিলেন। ৪ জুলাই ১৯০২ সম্বন্ধে তিনি ইতিমধ্যেই কিছু হৃদয়গ্রাহী ছবি এঁকেছেন, বিদেশিনী ভক্তিমতীরাও নিরন্তর অনুসন্ধানের পরে উপহার দিয়েছে নানা অমূল্য তথ্য, তবু লোভ হয়–আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি বসি পড়িছ আমার শেষদিনের কথা?
ব্যস্ত জীবনযাত্রার স্রোতে ভেসে যেতে যেতে শতবর্ষ পরের মানুষ জানুক, যাকে আমরা আজ প্রায় দেবতার সিংহাসনে বসিয়ে পূজা করছি, কত কঠিন ছিল তার জীবনসংগ্রাম। খ্যাতির হিমালয়শিখরে আরোহণ করেও কেন শেষ হয়নি তার প্রতিদিনের সংগ্রাম? কেন স্বামীজি বলেছিলেন,সতত প্রতিকূল অবস্থামালার বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের নামই জীবন? এবং সেই সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল, সনাতন ভারতবর্ষ জন্মদিবস অপেক্ষা মৃত্যুদিবসকে কেন এতো কম গুরুত্ব দিয়েছে?
শেষ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গিয়েছে এবং সেই উত্তর এই লেখার পরিসমাপ্তিতে উল্লিখিত হবে। কিন্তু তার আগে আমার অতি সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধানের একটা ছোট্ট ছবি তাড়াতাড়ি এঁকে ফেলা যাক।
নানা প্রশ্ন অবশ্যই জড়ো হয়ে আছে। কেন এবং কীভাবে বিবেকানন্দ এত কম বয়সে চলে গেলেন? মহামানুষদের জীবনপথ নিরন্তর কণ্টকিত করতে সমকাল কেন দ্বিধা করে না? এবং কেমন করে তিলেতিলে অতিপরিশ্রমে নিজেকে ক্ষয় করে ক্ষণজন্মা পুরুষরা এই বিশ্বসংসারকে চিরঋণে আবদ্ধ করে যান? আর সেই সঙ্গে একজন জার্মান দার্শনিকের সেই বিখ্যাত উক্তি–যদি কোনও মহাপুরুষকে সত্যিই শ্রদ্ধা করে থাক তবে তার তিরোধানে ক্রন্দন করো না, বরং তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্যে লেগে পড়।
আমাদের প্রথম কৌতূহল, প্রথম যুগের বিবেকানন্দকে আমরা তো প্রবল প্রতাপান্বিত শরীরের অধীশ্বর হিসেবেই দেখেছি। তার শরীর হঠাৎ এমনভাবে ভেঙে পড়ল কেন? একালের মানুষের শরীর তো এইভাবে জীর্ণ হয় না। পূর্বসূরীদের নির্দেশিত পথেই আমার এই অনুসন্ধান, তেমন কোনও অপ্রকাশিত তথ্য আমার হাতে নেই, কিন্তু বিভিন্ন সূত্র থেকে কুড়িয়ে নিয়ে একটা মালা গাঁথার চেষ্টা চালানো গেল।