এই ভ্রমণের সময় স্বামীজির শারীরিক অসুস্থতার তেমন বহিঃপ্রকাশ ছিল না। বরং তিনি সীমাহীন প্রাণশক্তিতে পূর্ণ। শুধু নব নব দেশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখছেন এবং অবসর সময়ে উদ্বোধন পত্রিকার জন্য পরিব্রাজক’ এর কিস্তি রচনা করছেন তা নয়, স্বামীজি সারাক্ষণ যেখানে যাচ্ছেন সেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং মাতিয়ে রাখছেন যাত্রাসঙ্গিনী ও সঙ্গীদের। সেসব দিনের হৃদয়গ্রহী বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে মাদা কালভে ও মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউডের স্মৃতিকথায়। পরিব্রাজক-এর পাঠক-পাঠিকারাও তার কিছুটা স্বাদ পেয়েছেন।
একনজরে স্বামীজির ভ্রমণসূচিটি এরকম : ২৪ অক্টোবর ১৯০০ সারারাত ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস দক্ষিণ ফ্রান্স দিয়ে চললো, পরের দিনের বেশির ভাগ সময় দক্ষিণ জার্মানি। ২৫ তারিখে ভিয়েনা পৌঁছে পরের দিন ভিয়েনাদর্শন হলো। এই শহর সম্বন্ধে লেখক বিবেকানন্দর মতামত : “ভিয়েনায় তিনদিন–দিক করে দিলে! প্যারিসের পর ইউরোপ দেখা চর্ব চূষ্য খেয়ে তেঁতুলের চাটনি চাখা; সেই কাপড়চোপড়, খাওয়া-দাওয়া, সেইসব এক ঢঙ,দুনিয়াসুদ্ধ, সেই এক কিম্ভুত কালো জামা, সেই এক বিকট টুপি।”
৩০ অক্টোবর ১৯০০ : স্বামীজির দল কনস্টান্টিনোপল পৌঁছলেন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে। এই ট্রেন বলকান দেশগুলির মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। লঙ্কাপ্রেমী স্বামীজির আনন্দের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এখানকার লঙ্কায় এমন ঝাল যে মাদ্রাজীদেরও কঁদিয়ে দেবে!
কনস্টানটিনোপল, অর্থাৎ ইস্তাম্বুলে, ক’দিন থাকা হয়েছিল? কারুর মতে দু’তিন দিন, আর মিস ম্যাকলাউডের স্মৃতি অনুযায়ী নদিন। গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক ন’দিনকেই নির্ভরযোগ্য মনে করেন। এই সময়েই ঘুরতে ঘুরতে এঁরা এক সুফি ফকিরের তাকিয়া দেখেন। এখানকার দরবেশরা রোগ সারায়। প্রথমে ঝুঁকে পড়ে কলমা পড়ে, তারপর নৃত্য করে; তখন ভাব হয় এবং ভাবাবেশে রোগীর শরীর মাড়িয়ে দিয়ে রোগ আরাম করে। রাস্তায় বেরিয়ে স্বামীজির ছেলেমানুষের স্বভাব সর্বদা ছিল। স্বামী গম্ভীরানন্দের বর্ণনায় : সুতরাং বালকসুলভ ভোলাভাজা দেখিয়া উহা কিনিয়া খাইলেন, সঙ্গীদের সহিত তুর্ক-দেশীয় অন্যান্য সুখাদ্যও আস্বাদন করিলেন।
১০ নভেম্বর কনস্টান্টিনোপল থেকে গ্রীসের উদ্দেশে যাত্রা। সেবার গ্রীসে তিন দিন থেকে ১৩ অথবা ১৪ নভেম্বর মিশরের উদ্দেশে যাত্রা। জাহাজের নাম ‘জার’। সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে দিগ্বিজয়ী বীরের মতন স্বামীজি কিভাবে গ্রীস জয় করে মিশরে উপস্থিত হয়েছিলেন তার বিবরণ বিভিন্ন স্মৃতিকথায় রয়েছে।
মনে রাখা ভাল, ইউরোপের যশস্বিনী মিউজিক বার্ড মাদাম কালভে এক দুঃসময়ে প্রাণঘাতিনী হবার চেষ্টা করেছিলেন, মার্কিন মুলুকে বিবেকানন্দ-সান্নিধ্যে এসে তিনি নবজীবন লাভ করেন।
এবার লক্ষ্যস্থল কায়রো। মিশরীয় সভ্যতার ওপর নতুন আলোকপাত করে সহযাত্রীদের রোমাঞ্চিত করছেন বিবেকানন্দ। এমনই রোমাঞ্চিত তারা, যে কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে তারা ট্রেনও ফেল করছেন! এই কায়রোতেই সবান্ধব বিবেকানন্দ পথ হারিয়ে পতিতাপল্লীতে ঢুকে পড়েছিলেন। সেখানে অসহায় অর্ধনগ্না রমণীদের দর্শনে যে প্রাণস্পর্শী নাটকের সৃষ্টি হয়েছিল তার বিবরণ বিবেকানন্দ অনুরাগীদের অজানা নয়। নাটকের চরমপর্বে চোখের জল ফেলতে ফেলতে এক ক্রন্দনরতা হতভাগিনী স্পেনীয় ভাষায় বলে উঠেছিল Hombre de Diosঈশ্বরের প্রেরিত মানুষ!
কায়রোপর্ব সম্বন্ধে অনেক কথাই অনেকদিন এদেশে অজানা ছিল। বিবেকানন্দর দেহাবসানের বহু বছর পরে মাদাম এমা কালভে মুখ খুলেছিলেন। পরলোকগত প্রকাশক রঞ্জিত সাহার সঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের নিবিড় যোগাযোগ ছিল দীর্ঘদিন। তিনি নিবেদিতার ইংরিজি পত্রাবলী ও ভূপেন্দ্রনাথ রচিত বিবেকানন্দ জীবনীর প্রকাশকও বটে। ওঁর কাছে শুনেছি, বিবেকানন্দর পারিবারিক সূত্রের ধারণা, কায়রোতে স্বামীজিকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। কিন্তু তার কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। আমরা স্বামীজির জীবনীর মাধ্যমে প্রথম দিকে জেনেছি, প্রিয় ভক্ত মৃত্যুপথযাত্রী ক্যাপটেন সেভিয়ারের জন্য ব্যাকুল হয়ে তিনি আচমকা মাঝপথে সব প্রোগ্রাম বাতিল করে দেশে ফিরতে চাইলেন।
কায়রোপর্ব সম্বন্ধে প্রধান প্রধান বিবেকানন্দ-বিশারদরা আজও কিছুটা আলো-আঁধারিতে থেকে গিয়েছেন মনে হয়। বিবেকানন্দ জীবনীকারের মতে, স্বামীজি কায়রোর যাদুঘর, স্ফিংকস (অর্ধনারী-সিংহ মূর্তি) ও পিরামিড দেখলেন। “বিগতগৌরব প্রাণহীন এইসব বিশাল স্মৃতিচিহ্নগুলি তাহার মনে এক অবসাদ আনিয়া দিল এবং তিনি তথা হইতে দূরে–স্বদেশে চলিয়া যাইবার জন্য ব্যগ্র হইয়া পড়িলেন।”
মিস ম্যাকলাউড ও এমা কালভে তাদের স্মৃতিকথায় কিছু নতুন খবর দিয়েছেন। কিন্তু এঁদের দুজনের সঙ্গেই কথা বলে মাদাম ভার্দিয়ার যে বিস্তারিত নোট অগ্রন্থিত অবস্থায় রেখে গিয়েছেন তার থেকেই বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
মাদাম কালভে অন্যত্র গান গাইতে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে মিস ম্যাকলাউডের কাছে শুনলেন, স্বামীজি খুব বিষণ্ণ অবস্থায় রয়েছেন। মাদাম কালভে জানতে চাইলেন, কেন স্বামীজি মাঝপথে যাত্রাভঙ্গ করতে চাইছেন? বিমর্ষ বিবেকানন্দ বললেন, তিনি তার গুরুভাইদের কাছে ফিরে যেতে চান। তাকে আশ্বস্ত করা হল, টাকা পয়সার জন্যে চিন্তা নেই, প্রয়োজন হলে ফিরে যাবার টিকিট অবশ্যই কিনে দেবেন মাদাম কালভে। কিন্তু কেন আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন?” জিজ্ঞেস করলেন মাদাম কালভে।