ঠিক তিনদিন পরেই (৭ মার্চ) কিন্তু দুঃসংবাদ।”দিনকয়েক যাবৎ আমার শরীর খারাপ হয়েছে এবং বড় বিশ্রী বোধ হচ্ছে। আমার বোধ হয়, রোজ রাত্রে বক্তৃতা দেবার ফলেই এরকম হয়েছে। আমার আশা আছে যে, ওকল্যান্ডের কাজের ফলে অন্তত নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত ফিরে যাবার টাকা সংগ্রহ করতে পারব।” নিউ ইয়র্কে পৌঁছে ভারতে ফেরবার টাকা যোগাড়ের স্বপ্ন দেখছেন আমাদের স্বামীজি।
রোগ-জর্জরিত স্বামীজি স্যানফ্রান্সিস্কো থেকে নিজেকে খুলে ধরেছেন স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে ১২ মার্চের এক চিঠিতে: “শরৎকে বলল যে, আমি বেশি খাটছিনা আর। তবে পেটের খাওয়ার মতো না খাটলে শুকিয়ে মরতে হবে যে।…আমি সত্য সত্য বিরাম চাই, এ রোগের নাম নিউরোসথেনিয়া–এ স্নায়ুরোগ। এএকবার হলে বৎসর কতক থাকে। তবেদু’চার বৎসর একদম রেস্টহলে সেরে যায়।..এদেশ এই রোগের ঘর। এইখান থেকেই উনি ঘাড়ে চড়েছে। তবে উনি মারাত্মক হওয়া দুরে থাকুক, দীর্ঘ জীবন দেন। আমার জন্য ভেবো না। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে যাব।”
.
১৮৯৯ নভেম্বর দ্বিতীয় সপ্তাহে স্বামীজি একজন বিখ্যাত ডাক্তার ভক্তর (ডাক্তার এগবার্ট গার্নসি) নিউ ইয়র্কের বাড়িতে চলে আসেন রিজলি ম্যানর থেকে। ডাক্তার গানসির পরামর্শ, অস্টিওপ্যাথ ডাক্তার হেলমারের চিকিৎসায় থাকুন স্বামীজি। ওঁর কথা শোনেন স্বামীজি। কিন্তু ডাক্তারের আতিথেয়তায় থাকতে থাকতেই তাঁর প্রবল সর্দিজ্বর হয়। সে বিবরণ মার্কিনি ভক্তরা সংগ্রহ করেছেন।
হাতুড়ে মিসেস মিল্টনের চৌম্বক চিকিৎসা! ইনি লিখতে পড়তে পারতেন না। কথা বলতেন নিগ্রো ডায়ালেক্টে। তার হাতে রোগীর কি হলো? “আমার বেলায় বুকে অনেকগুলি বড় বড় লাল লাল দাগ ফুটে উঠেছে।” আরোগ্যের ব্যাপারে কতদুর কী হয়, তা পরে বিস্তারিত জানাবার প্রতিশ্রুতি স্বামীজি দিচ্ছেন জননীসমা মিসেস বুলকে।
শরীরের অন্য সব সমস্যার সমাধান না হোক, স্বামীজি এই সময় বিনিদ্রার হাত থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েছিলেন মনে হয়। নিবেদিতাকে তিনি লিখছেন, “আমি এখন সকাল-সন্ধ্যা খুব খাঁটি, যখন যা পাই খাই, রাত্রি বারটায় শুতে যাই, আর কি গভীর নিদ্রা! আগে কখনও আমার এমন ঘুমোবার শক্তি ছিল না।”
শেষ পর্যন্ত চৌম্বক চিকিৎসা যে কিছু করতে পারলো না তা কয়েকদিনের মধ্যেই স্বামীজিকে স্বীকার করতে হলো মিস ম্যাকলাউডকে লেখা চিঠিতে। “যাই হোক আমার চলে যাবে।”
এপ্রিল মাসে আলমেডা থেকে লেখা মিসম্যাকলাউডকে লেখা স্বামীজির আর এক চিঠিতে বিষণ্ণ বিদায়ের সুর, শরীরের চেয়ে মনের শান্তি স্বচ্ছতাই খুব বেশি বোধ করছি, লড়াইয়ে হার-জিত দুই-ই হ’ল–এখন পুটলি-পাঁটলা বেঁধে সেই মহান মুক্তিদাতার অপেক্ষায় যাত্রা করে বসে আছি।”
এপ্রিলের শেষেও স্বামীজির অসুস্থতা ও জ্বর। সেই সঙ্গে স্নায়ুরোগ। ২রা মে ১৯০০ নিবেদিতাকে তিনি লিখছেন, “আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম-মাসখানেক ধরে কঠোর পরিশ্রমের ফলে আবার রোগের আক্রমণ হয়েছিল। যাই হোক, এতে আমি এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে আমার হার্ট বা কিডনিতে কোন রোগ নাই, শুধু অতিরিক্ত পরিশ্রমে স্নায়ুগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।”
স্নেহময় ডাক্তার লোগানের উল্লেখ রয়েছে এই সময়ের চিঠিতে। তার ঠিকানা ৭৭০ ওক স্ট্রিট। ডাক্তার লাগানের নির্দেশ, সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোনো যাত্রার ধকল নয়। এই ডাক্তার আমাকে সবল করে ছাড়বে! আমার পেট ভাল, নার্ভ ফাইন।”
এই সময় আমরা আর এক ডাক্তারের খোঁজ পাচ্ছি। ডাক্তার উইলিয়াম ফস্টার, ঠিকানা ১৫১০ মার্কেট স্ট্রিট, তাঁর কাছেও চিকিৎসা হয়েছিল। অসুস্থ স্বামীজির কিন্তু রসবোধের কোন অভাব নেই। ২৩ জুন মেরি হেলকে নিউইয়র্ক থেকে লিখছেন, “তোমার চিঠিটা হজম করতে পারিনি, কারণ গত কয়েকদিন অজীর্ণতা কিছু বেশীরকম ছিল।”
আগস্টের মাঝামাঝি বিবেকানন্দকে আমরা মানুষের মহাতীর্থ প্যারিসে কর্মব্যস্ত দেখছি। স্বামী তুরীয়ানন্দকে তিনি লিখছেন (সেপ্টেম্বর ১৯০০), আগামীকাল যার ফ্ল্যাটে থাকবেন তার বাড়ি দেখে এসেছেন, ছ’তলার ফ্ল্যাট, কিন্তু লিফট নেই। “চড়াই-ওতরাই। ওতে কিন্তু আমার আর কষ্ট হয় না।”
তুরীয়ানন্দকে লেখা আরও এক চিঠি : “শরীর একরকম গড়মড় করে চলছে। খাটলেই খারাপ, না খাটলেই ভাল, আর কি? মা জানেন।”
*
প্যারিসে একদিন মধ্যাহ্নভোজের সময় কিংবদন্তি গায়িকা মাদাম এমা কালভে তার বান্ধবী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে বললেন, তিনি মিশরে যাচ্ছেন। মিস ম্যাকলাউড যখন বললেন তিনিও সহযোগী হবেন, অমনি মাদাম কালভে স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমার অতিথি হিসেবে মিশরে যাবেন কি?”
স্বামীজি সম্মত হলেন। মিশরে কী হয়েছিল তা যথাসময়ে জানা যাবে। মাদাম কালভে স্বামীজিকে বাবা বলতেন।
পূর্ব থেকে পশ্চিম নয়, প্রজ্বলিত সূর্য এবার পশ্চিমে থেকে ফিরে আসছেন পূর্বগগনে।
প্যারিস থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৪ অক্টোবর ১৯০০। ঐদিন মাদাম কালভের বিশিষ্ট অতিথি স্বামী বিবেকানন্দ প্যারিসের রেল স্টেশন থেকে ভুবনবিদিত ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের যাত্রী হলেন। এবারের ভ্রমণপর্ব শেষ হয়েছিল ২৬ নভেম্বর ১৯০০, যেদিন মিশরের পোর্ট তাফিক থেকে বিবেকানন্দ বোম্বাইমুখী ইতালীয় জাহাজ এস এস রুবাত্তিনোতে উঠে বসলেন স্বদেশ ফিরে যাবার ব্যাকুলতা নিয়ে।