ফেব্রুয়ারির গোড়ায় মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে স্বামীজির চিঠি, “বৈদ্যনাথে বায়ু পরিবর্তনে কোন ফল হয়নি। সেখানে আটদিন আট রাত্রি শ্বাসকষ্টে প্রাণ যায় যায়। মৃতকল্প অবস্থায় আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়। এখানে এসে বেঁচে উঠবার লড়াই শুরু করেছি।”
ডাক্তার সরকার যে এইসময় তার চিকিৎসা করছেন তাও মিস ম্যাকলাউডকে জানিয়েছেন তিনি। “আগের মতো হতাশ ভাব আর নেই অদৃষ্টের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। এটা আমাদের পক্ষে বড় দুর্বৎসর।”
“দু’বৎসরের শারীরিক কষ্ট আমার বিশবছরের আয়ু হরণ করেছে,” স্বামীজি এক চিঠিতে লিখেছিলেন ১৮৯৯ এপ্রিল মাসে। “ভাল কথা, কিন্তু এতে আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। হয় কি? সেই আপনভোলা আত্মা একই ভাবে বিভোর হয়ে তীব্র একাগ্রতা ও আকুলতা নিয়ে ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে আছে।”
এই সময়ে স্বামীজির কোষ্ঠী পরীক্ষা করিয়ে প্রবল বকুনি খেয়েছিলেন নিবেদিতা। কোষ্ঠীর ভাষ্য : স্বামীজির লগ্নে বৃহস্পতি, অতএব নয় বছর কোন ভয় নেই, তবে শরীর অসুস্থ থাকবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীকে স্বামীজি কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
*
২০ জুন ১৮৯৯। স্বামী তুরীয়ানন্দ ও মানসকন্যা নিবেদিতাকে নিয়ে বিবেকানন্দ বিদেশের উদ্দেশে গোলকুন্ডা জাহাজে উঠলেন কলকাতা বন্দর থেকে। যাঁরা তাঁকে জাহাজে তুলে দিতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন শচীন্দ্রনাথ বসু। তাঁর মতে, “সত্যি কথা বলতে কি তাকে মোটেই সুস্থ দেখাচ্ছিল না।”
জাহাজে ধূমপান, জলপান, ইত্যাদি কমিয়ে দিয়ে স্বামীজি বেশ ভাল ছিলেন। নিবেদিতাকে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার মতন মানুষেরা চরমের সমষ্টি, আমি প্রচুর খেতে পারি, একেবারে না খেয়ে থাকতে পারি; অবিরাম ধূমপান করি, আবার তাতে সম্পূর্ণ বিরত থাকি। ইন্দ্রিয় দমনে আমার ক্ষমতা অথচ ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যেও থাকি। নাহলে দমনের মূল্য কোথায়?”
৩১ জুলাই ১৮৯৯ লন্ডনের টিলবেরি ডকে স্বামীজিকে জাহাজ থেকে নামতে দেখে জনৈকা ভক্তিমতী লিখলেন, “তিনি খুব রোগা হয়ে গিয়েছিলেন, তাকে দেখে মনে হল যেন ঠিক একটি বালক।”
সমুদ্রগামী জাহাজে স্বামীজির শরীর ভাল ছিল। কিন্তু ডাঙায় নামার সঙ্গে সঙ্গে পেটে বায়ুর প্রকোপ।
স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি লিখলেন (১০ আগস্ট) “একজন বড় ডাক্তার বললে, নিরামিষ খাও, আর ডাল ছুঁয়ো না। ইনি এখানকার একজন মুরুব্বি ডাক্তার। এঁর মতে ইউরিক এসিড-গোলমালে যত ব্যারাম হয়। মাংস এবং ডাল ইউরিক এসিড বানায়; অতএব ত্যাজ্যং ব্রহ্মপদং’ ইত্যাদি। যা হোক আমি তাকে সেলাম করে চলে এলাম।… এগজামিন করে বললে চিনি-ফিনি নেই-আলবুমেন আছে। যাক! নাড়ী খুব জোর, বুকটাও দুর্বল বটে। মন্দ কি, দিনকতক হবিষ্যাশী হওয়া ভাল।”
দু’চারদিনের মধ্যেই আমেরিকা-যাত্রার ইঙ্গিত রয়েছে স্বামীজির এই চিঠিতে। বিবেকানন্দ সেবার নিউ ইয়র্কে পৌঁছলেন ২৬ আগস্ট ১৮৯৯।
.
স্বামীজির স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য মার্কিনী ভক্তরা বড় ডাক্তারের সঙ্গে হাতুড়ে ডাক্তারদের খোঁজখবর করতেও অনুৎসাহিত নন।
সেপ্টেম্বর মাসে রিজলি ম্যানর থেকে স্বামীজি তাঁর স্নেহের মেরী হেলকে লিখছেন, “তোমার চিকিৎসা (ক্রিশ্চান সায়ান্স) দিয়ে আমাকে ভাল করতে পারলে না। তোমার রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা সম্বন্ধে আমার আস্থা বেশ কিছুটা কমে যাচ্ছে।…আমার চুল তাড়াতাড়ি পেকে যাচ্ছিল, এখন কোনক্রমে তা বন্ধ হয়েছে। দুঃখের বিষয় এখন সবেমাত্র কয়েকটি পাকা চুল আছে; অবশ্য ভাল করে সন্ধান করলে আরও অনেক বেরিয়ে পড়বে। শুভ্র কেশ আমার বেশ পছন্দ।”
একই চিঠিতে স্বামীজি সরসভাবে মিস মেরী হেলকে লিখছেন, “তুমি কি অস্থিবিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু জানো? নিউ ইয়র্কে একজন এসে বাস্তবিক অবাক কাণ্ড করছে। এক সপ্তাহ পরে তাকে দিয়ে আমার হাড়গোড় দেখানো হবে।”
২২ ডিসেম্বর তার ধীরামাতা মিসেস সারা বুলকে চৌম্বক-চিকিৎসার খবর দিচ্ছেন স্বামীজি। “সম্প্রতি আমার আবার শরীর খারাপ হয়েছিল। তাই চিকিৎসক রগড়ে রগড়ে আমার ইঞ্চি কয়েক চামড়া তুলে ফেলেছে। এখন আমি তার যন্ত্রণা বোধ করছি।”
পরের দিন সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজির রিপোর্ট, “সত্যি আমি চৌম্বক চিকিৎসা-প্রণালীতে ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছি।…আমার শরীরের কোন যন্ত্র কোনকালেই বিগড়ায়নি-স্নায়বিক দৌর্বল্য ও অজীর্ণতাই আমার দেহে যা-কিছু গোল বাধিয়েছিল।”
ম্যাগনেটিক হাতঘসার মহিলা চিকিৎসকটি জুটিয়েছিলেন মিস। জোসেফিন ম্যাকলাউড।”হাতঘসা চিকিৎসার ফলেই হোক, ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ওজোন’ বাষ্পের ফলেই হোক, অথবা বর্তমান কর্মের দশা কেটে যাবার ফলেই হোক, আমি সেরে উঠছি। পেটভরা খাবার পরে তিনমাইল হাঁটতে পারা একটা বিরাট ব্যাপার নিশ্চয়।” এই রিপোর্ট স্বামীজি স্বয়ং দিচ্ছেন তাঁর ধীরামাতা মিসেস বুলকে লস্ এঞ্জেলেস থেকে ২৭ ডিসেম্বর ১৮৯৯।
ভগ্ন স্বাস্থ্যের কথা স্বামীজি আর কত বলবেন। ১৯০০ সালের মার্চ মাসে স্যানফ্রানসিসকো থেকে মিসেস বুলের কাছে তার দাবি :”সম্ভবতঃ স্বাস্থ্যের উন্নতিই হচ্ছে–যদিও অজ্ঞাতসারে। আমি ৩০০০ শ্রোতাকে শোনাবার মতন উঁচু গলায় বক্তৃতা দিতে পারি; ওকল্যান্ডে আমায় দু’বার তাই করতে হয়েছিল। আর দু’ঘণ্টা বক্তৃতার পরেও আমার সুনিদ্রা হয়।”