মৃত্যুচিন্তার যে অবসান নেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লাহোর থেকে ইন্দুমতী মিত্রকে লেখা চিঠিতে : “কলিকাতায় এক মঠ হইলে আমি নিশ্চিন্ত হই। এত যে সারা জীবন দুঃখ কষ্টে কাজ করিলাম, সেটা আমার শরীর যাওয়ার পর নির্বাণ যে হইবে না, সে ভরসা হয়।”
একই দিনে (১৫নভেম্বর ১৮৯৭) স্বামীজি জানাচ্ছেন স্বামীব্ৰহ্মানন্দকে, “আমার শরীর বেশ আছে। তবে রাত্রে দু-একবার উঠিতে হয়। নিদ্রা উত্তম হইতেছে। খুব লেকচার করিলেও নিদ্রার ব্যাঘাত হয় না, আর এক্সারসাইজ রোজ আছে। ভাত তো আজ তিন মাস রোজ খাই, কিন্তু কোনও গোল নাই। এইবার উঠে-পড়ে লাগো।”
দশদিন পরেই স্বামীজি ডেরাডুন থেকে স্বামী প্রেমানন্দকে পুরনো ঘি পাঠাতে অনুরোধ করছেন, কারণ “ঘাড়ের একটা বেদনায় অনেকদিন যাবৎ ভুগিতেছি।” এই ঘি কোথা থেকে সংগ্রহ হবে? “হাবু, শরৎ (উকিল)-এর নিকট নিশ্চিত পাইবে।”
ঐ বছরের শেষ পর্বে আর একটি মাত্র রোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে, দিল্লিতে স্বামীজি সর্দির প্রকোপ এড়াতে পারছে না।
.
আরও কয়েকটা মাস ঝপঝপ করে এগিয়ে যাওয়া যাক। স্বামীজি কাজের মাধ্যমে নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে ফেললেন। তিনি নিবেদিতাকে (২৫ আগস্ট ১৮৯৮) কাশ্মীর থেকে লিখছেন, “কাজের চাপে নিজেকে মেরে ফেলো না যেন। ওতে কোন লাভ নেই; সর্বদা মনে রাখবে কর্তব্য হচ্ছে যেন মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো–তার তীব্র রশ্মি মানুষের জীবনী শক্তি ক্ষয় করে।”
এর আগে ১৭ জুলাই ১৮৯৮ শ্রীনগর থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজির চিঠি, “যদি উত্তম ঘর হয় এবং যথেষ্ট কাঠ থাকে এবং গরম কাপড় থাকে, বরফের দেশে আনন্দ বই নিরানন্দ নাই। এবং পেটের রোগের পক্ষে শীতপ্রধান দেশ ব্রহ্মৌষধ।..আমার শরীর বেশ আছে। রাত্রে প্রায় আর উঠিতে হয় না, অথচ দু-বেলা ভাত আলু চিনি যা পাই তাই খাই। ওষুধটা কিছু কাজের নয়-ব্ৰহ্মজ্ঞানীর শরীরে ঔষধ ধরে না। ও হজম হয়ে যাবে কিছু ভয় নাই।”
কিন্তু ঠিক দুমাস পরে (১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮) শ্রীনগর থেকে শ্রীযুক্ত হরিপদ মিত্রকে অবসন্ন স্বামীজির চিঠি মনকে বড় কষ্ট দেয়। “মধ্যে আমার শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায় কিঞ্চিৎ দেরি হইয়া পড়িল, নতুবা এই সপ্তাহের মধ্যে পঞ্জাবে যাইবার পরিকল্পনা ছিল।…ডাক্তার যাইতে নিষেধ করিতেছেন।”
মাত্র পঞ্চাশটি টাকার জন্য অসুস্থ স্বামীজি চিঠি লিখছেন হরিপদ মিত্রকে। অনুরোধ করছেন টেলিগ্রামে টাকা পাঠাতে। “আমার এখানকার সমস্ত খরচপত্র উক্ত আমেরিকান বন্ধুরা দেন এবং করাচি পর্যন্ত ভাড়া প্রভৃতি তাহাদের নিকট হইতেই লইব। তবে যদি তোমার সুবিধা হয়, ৫০ টাকা টেলিগ্রাম করিয়া ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, চিফ জজ, কাশ্মীর স্টেট, শ্রীনগর এঁর নামে পাঠাইলে অনেক উপকার হইবে। কারণ সম্প্রতি ব্যারামে পড়িয়া বাজে খরচ কিছু হইয়াছে এবং সর্বদা বিদেশী শিষ্যদের নিকট টাকা ভিক্ষা করিতে লজ্জা করে।”
একই দিনে চিঠির মাধ্যমে খেতড়ির মহারাজা অজিত সিং-এর শরণাপন্ন হয়েছে স্বামীজি।”এখানে আমি দু’সপ্তাহ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।… আমার কিছু টাকার টান পড়েছে।..অসুখ করলে খরচের বহর অনেক বেড়ে যায়। এই জগতে শুধু একজনের কাছেই আমার কিছু চাইতে লজ্জা হয় না এবং তিনি হলেন আপনি।”
.
ডায়াবিটিস, বিনিদ্রা এবং হার্টের ট্রাবল নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে স্বামীজিকে বড় ডাক্তারের শরণ নিতে হলো। তার আর্থিক অবস্থা তখন কেমন তা আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি।
স্বামী ব্রহ্মানন্দ যে খ্যাতনামা ডাক্তার কে এল দত্তর চেম্বারে গেলেন ব্যবস্থার জন্য তা আমরা তার ডায়রি থেকে জানতে পারছি। ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসীকে সে যুগের বড় ডাক্তারকে কত দিতে হল তা সকলের জেনে রাখা ভাল। ওষুধের খরচ দশ টাকা, কিন্তু ফি বাবদ চল্লিশ টাকা! ১৮৯৮ সালের অক্টোবর মাসের চল্লিশ টাকা আজকের মূল্যায়নে কত টাকা তা আন্দাজ করতে অনুরোধ জানাই পাঠক-পাঠিকাদের।
স্বামীজির স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রিয় গুরুভাইরা হাতগুটিয়ে বসে থাকতে মোটেই রাজি নন। তারা বড় ডাক্তারের বড় কড়ি জমা দিয়ে, কবিরাজেরও ব্যবস্থা করেছিলেন।
কিন্তু ডাক্তারের বড় চিকিৎসাতে স্বাস্থ্যের উন্নতি না হওয়ায়, বায়ু পরিবর্তনের জন্য স্বামীজি ১৯ ডিসেম্বর ১৮৯৮ ব্রহ্মচারী হরেনকে নিয়ে দেওঘরে গেলেন। কলকাতায় ফিরে আসেন ২২ জানুয়ারি ১৮৯৯। দেওঘরে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ভবনে হাঁপানির প্রবল আক্রমণে স্বামীজির জীবন সংকটাপন্ন।
যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের সংযোজন : “সময় সময় এত শ্বাসকষ্ট হইত যে মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিত, সর্বাঙ্গে আক্ষেপ হইত এবং উপস্থিত সকলে মনে করিতেন, বুঝিবা প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া যাইবে। স্বামীজি বলিতেন, এইসময় একটি উঁচু তাকিয়ার উপর ভর দিয়া বসিয়া মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতেন।”
বেলুড় থেকে আমেরিকান শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে (২৬ জানুয়ারি ১৮৯৯) স্বামীজি মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হবার খবর দিচ্ছেন। “ডায়াবিটিস উধাও, কিন্তু পরিবর্তে যা এসেছে তাকে কোনো কোনো ডাক্তার অ্যাজমা, আবার কেউ কেউ ডিসপেপসিয়া বলেন। দুশ্চিন্তা ঘটাবার মতন অসুখ, দিনের পর দিন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার মতন অবস্থা। যদি মার্চের মধ্যে সুস্থ হই তাহলে ইউরোপে যাব।”