শরিকী মামলায় হাজার রকম অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ ওঠে, সে নিয়ে কেউ তেমন উদ্বিগ্নও হন না, কিন্তু এক্ষেত্রে এইসব অভিযোগের আইনী মোকাবিলার জন্যে বৈরাগী বিবেকানন্দকে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।
কিন্তু বিশ্বনাথ পরিবার যে লক্ষ্মীর কৃপাধন্য ছিলেন তার অনেক নমুনা আমরা ভ্রাতৃস্মৃতি থেকে পাচ্ছি। যেমন ধরুন খাওয়া-দাওয়ার কথা। শুনুন বড় ও মেজ দুইভাইয়ের জলখাবারের কথা। তখন কলকাতার পাঁঠার দোকানে পাঁঠার মুড়ি বিক্রি হতো না। দুইভাই নরেন্দ্র ও মহেন্দ্র পাঠাওয়ালার সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। দুই চার আনায় দশ বারোটা পাঁঠার মাথা যোগাড় হতো। দশ বারোটা মুড়ি ও সের দুই আড়াই কড়াইশুটি–একসঙ্গে ফুটিয়ে তরকারি। মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিকেলে আমি ও স্বামীজি স্কুল থেকে এসে ওই তরকারি ও খান-ষোল করে রুটি জলখাবার খেতাম।”
আর একদিনের কথা। “বড়দা একবার নিলামে ফিরিঙ্গিপাড়া থেকে পাঁচ আনা দিয়ে কেটলি কিনে আনলো। ওপরটা কালিঝুলি মাখা–ওমা, ভুসোগুলো উঁচতে চাচতে দেখি, ভিতরটা খাঁটি রুপো!”
এইসব ঘটনা সংসারে অর্থকষ্টের ইঙ্গিত দেয় না, বরং প্রাচুর্যের কথাই বলে। ১৮৮০-৮৪ সাল সস্তাগণ্ডার সময়, তখন শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তদের অফিসে মাস মাইনে ছিল পনেরো টাকার মতন। সেই সময় ভুবনেশ্বরী দেবীর পারিবারিক সংসার খরচ ছিল মাসে হাজার টাকা!
.
মায়ের কথায় আবার আসা যাক। বিবেকানন্দ তাঁর বন্ধুদের বলতেন, “আমি কি অমনি হয়েছি, আমার জন্যে আমার মা কত তপস্যা করেছেন।” অন্যত্র তিনি মুক্তকণ্ঠে বলেছেন, “আমার জ্ঞানের বিকাশের জন্য আমি মায়ের কাছে ঋণী।”
ভুবনেশ্বরীর গায়ের রঙ ছিল ফর্সা, কণ্ঠ সুমধুর, প্রতি পদক্ষেপে আভিজাত্য, বুদ্ধিমতী, কার্যকুশলা, মিতভাষিণী, গম্ভীর প্রকৃতি, আলাপে মিষ্টস্বভাব, কিন্তু তেজস্বিনী। ছেলেকে তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন, “আজীবন পবিত্র থাকিও, নিজের মর্যাদা রক্ষা করিও, কখনও অপরের মর্যাদা লঙ্ঘন করিও না। খুব শান্ত হইবে, কিন্তু আবশ্যক হইলে হৃদয় দৃঢ় করিবে।”
এমন মায়ের ছেলে বলেই, জোরগলায় বিবেকানন্দ বলতে পেরেছেন, “যে মাকে সত্য সত্য পূজা করতে না পারে, সে কখনও বড় হতে পারে না।”
বড় কঠিন কথা, কিন্তু আমাদের এই দেশে নিতান্ত ফেলে দেবার মতন আদর্শ নয়। একজন বিদেশিনী অনুরাগিনী একবার রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখেছিলেন, এঁদের প্রায় সবার ওপর গর্ভধারিণী জননীর প্রভাব খুব বেশি, সে তুলনায় বাবার প্রভাব উল্লেখযোগ্য নয়।
নরেনের সমীক্ষা ভুবনেশ্বরী দেবী নিজেই ভালভাবে করেছে। তিনি বলতেন, “ছেলেবেলা থেকে নরেনের একটা মস্ত দোষ ছিল, কোন কারণে রাগ হলে আর জ্ঞান থাকতো না, বাড়ির আসবাবপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করতো।”
তার দুই দিদি (হারামণি ও স্বর্ণময়ী) ভাইয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হতেন। কখনও তাড়া করে তাকে ধরতে গেলে বিলু দৌড়ে গিয়ে আঁস্তাকুড়ে আশ্রয় নিতেন এবং সেখানে মনের সাধে ভেঙচাতে ভেঙচাতে মৃদুহাস্য সহকারে বলতেন, “ধর না, ধরনা।” শিষ্যদের কাছে পরবর্তীসময়ে স্বামীজির সপ্রসন্ন স্বীকারোক্তি, “ছেলেবেলায় আমি বড় ডানপিটে ছিলাম, তা না হলে কি আর একটা কানাকড়ি সঙ্গে না নিয়ে দুনিয়াটা ঘুরে আসতে পারতুম রে।”
মায়ের চরিত্রের আর একদিক বিবেকানন্দকে মুগ্ধ করেছিল। ভুবনেশ্বরীর। সংযমশক্তি। “মা একবার সুদীর্ঘ চোদ্দ দিন উপবাসে কাটিয়েছিলেন।” এই শক্তির প্রতিফলন আমরা বিবেকানন্দর জীবনের শেষপর্যন্ত দেখেছি, তিরোধানের কিছুদিন আগে কবিরাজের উপদেশ অনুযায়ী একুশ দিন তিনি জল না খেয়েই সবার বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিলেন।
সুখী সোনার সংসারের শত শত কাহিনী বিভিন্ন স্মৃতিকথায় ছড়িয়ে আছে। এই আনন্দময় বিবেকানন্দকে আমার ভীষণ ভাল লাগে। যেমন ধরুন, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয়ভক্ত গুরুপ্রাণ রামচন্দ্র দত্তের কথা। এই আত্মীয়ের বিয়েতে নরেন মহানন্দে নিতবর হয়েছিলেন।
ছোটবেলায় দত্ত পরিবারের স্বর্ণযুগ প্রসঙ্গে প্রবীণ মহেন্দ্রনাথ একবার একটা দামী কথা বলেছিলেন, “মানুষের শেষজীবনে সমস্ত ছেলেবেলাকার ভাব, বংশের ধারা ফিরে আসে। এই দ্যাখ, ছেলেবেলায় যেসব খেতুম, যেসব শখ ছিল, এখন সেইসব মনে হচ্ছে–সেই কড়াইয়ের ডালের বড়া, ধোঁকা, এইসব। এইরকম হয়। স্বামীজি শেষটায় তখন মঠে আছেন। একদিন বললেন–”আমায় সব যোগাড় করে দে। আমি ফুলুরি করব। তেল, কড়া, বেসন সব দেওয়া হল, মায় খুরো দেওয়া সিঁড়ি পর্যন্ত স্বামীজি ঠিক ফুলুরিওয়ালার মতন করে বসলেন, হাঁটু থেকে কাপড় গুটোলেন, ফুলুরি ভাজতে ভাজতে ছেলে মানুষের মতো খদ্দের ডাকতে লাগলেন, আয় খদ্দের আয়।”
.
বিশ্বনাথ দত্তের শারীরিক অসুস্থতা এবং আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভুবনেশ্বরী ও তার জ্যেষ্ঠপুত্রের অন্তহীন অগ্নিপরীক্ষার শুরু। তবে তার কিছু আগেই শরিকী সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে। এই বিরোধ কী ধরনের তার বিস্তারিত বিবরণ আমাদের হাতে নেই, কিন্তু আমরা জানি যৌথপরিবারের বিষাক্ত পরিবেশে তিতিবিরক্ত ভুবনেশ্বরী ও পুত্রকন্যাদের নিয়ে বিশ্বনাথ তাঁর মৃত্যুর আগের বছরে ছাতুবাবু বাজারের কাছে ৭ ভৈরব বিশ্বাস লেনে একটা বাড়িভাড়া করে উঠে যান। কিন্তু পরে তিনি সপরিবারে আবার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে আসেন। বিশ্বনাথ পরিবারের এই ফিরে আসায় উকিল খুড়ো তারকনাথ তেমন খুশি হননি বলে শোনা যায়।