পরের দিনে জনৈক এক আমেরিকান ভক্তকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট, স্বামীজি আবার অজীর্ণরোগে মাঝে মাঝে ভুগছে এবং তা সারাবার জন্যে “নিজের বিশ্বাস বলে রোগ সারানোর (ক্রিশ্চান সায়ান্স মত অনুযায়ী) বিশেষ চেষ্টাও করছি। দার্জিলিং-এ শুধু মানসিক চিকিৎসাসহায়েই আমি নীরোগ হয়েছিলাম।…যদি শেষপর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভেঙেই পড়ে, তাহলে এখানে কাজ একদম বন্ধ করে দিয়ে আমি আমেরিকায় চলে যাব। তখন আমাকে আহার ও আশ্রয় দিতে হবে–কেমন, পারবে তো?”
এদিকে ডায়াবিটিসের প্রকোপ বোধ হয় কমের দিকে। স্বামীজি এবার ব্রহ্মানন্দকে লিখছেন, “আমি সেরেসুরে গেছি। শরীরে জোরও খুব; তৃষ্ণা নাই…কোমরে বেদনা-ফেদনা নাই; লিভারও ভাল। শশীর ঔষধে কি ফল হ’ল বুঝতে পারলাম না কাজেই বন্ধ।”
শরীরে নানা রোগের প্রকোপ, কিন্তু জর্জরিত বা পরাজিত নন আমাদের বিবেকানন্দ।
এই সময় তিনি যেসব বৈপ্লবিক কাজকর্মের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন তা আজও মানুষকে বিস্মিত করে। আলমোড়া থেকেই আপনজনদের কাছে যুগনায়ক পাঠাচ্ছেন তার মৃত্যুঞ্জয়ী বাণী, “হে মূর্খগণ, যে-সকল জীবন্ত নারায়ণে ও তাঁর অনন্ত প্রতিবিম্বে জগৎ পরিব্যাপ্ত, তাকে ছেড়ে তোমরা কাল্পনিক ছায়ার পিছনে ছুটেছ! তার–সেই প্রত্যক্ষ দেবতারই উপাসনা করো এবং আর সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।”
পরের দিনই (১০ জুলাই, ১৮৯৭) অভিন্নহৃদয় বন্ধু স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি জানাচ্ছেন, রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম দুর্ভিক্ষ সেবাকার্য “অতীব সুন্দর।…
ফিলসফি, যোগ, তপ, ঠাকুরঘর, আলোচাল, কলা মূলো–এসব ব্যক্তিগত ধর্ম, দেশগত ধর্ম; পরোপকারই সার্বজনীন মহাব্রত।”
সারাক্ষণই শরীরকে ডোন্টকেয়ার করে বিবেকানন্দ ভাবছেন তার প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘের কথা। পরের দিনই স্বামী শুদ্ধানন্দকে লিখছেন, “এখন মনে হচ্ছে–মঠে অন্তত তিনজন করে মহান্ত নির্বাচন করলে ভাল হয়; একজন বৈষয়িক ব্যাপার চালাবেন, একজন আধ্যাত্মিক দিক দেখবেন, আর একজন জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করবেন।”
আরও লিখছেন, “মঠ দর্শন করতে কেবল কলকাতার বাবুর দল আসছেন জেনে বড় দুঃখিত হলাম। তাদের দ্বারা কিছু হবে না। আমি চাই সাহসী যুবকের দল–যারা কাজ করবে; আহাম্মকের দল দিয়ে কি হবে?”
প্রিয় শিষ্যদের তিনি বলছেন, “তোমরা মনে রেখো, আমি আমার গুরুভাইদের চেয়ে আমার সন্তানদের নিকট বেশী আশা করি–আমি চাই, আমার সব ছেলেরা, আমি যতবড় হতে পারতাম, তার চেয়ে শতগুণ বড় হোক।”
মনে রাখতে হবে, স্বামীজি যখন এইসব চিন্তা করছেন, তখন তার “উঠতে বসতে হাঁপ ধরে…পূর্বে আমার দুইবার সর্দি-গরমি হয়, সেই অবধি রৌদ্র লাগিলেই চোখ লাল হয়, দুই তিনদিন শরীর খারাপ যায়।”
নিজের শরীরযন্ত্রণার কথা ভুলে স্বামীজি তাঁর গুরুভাই রামকৃষ্ণানন্দের শরীর নিয়ে অনেক বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন।”তোমার শরীরের ওপর বিশেষ লক্ষ্য রাখবে-তবে বিশেষ আতুপুতুতে শরীর উল্টে আরও খারাপ হয়ে যায়।”
রোগভোগের কথা স্বামীজি একেবারেই মনে রাখতে চান না। কিন্তু মধ্যিখানের কিছু চিঠি থেকে বোঝা যাচ্ছে টনসিল, জ্বর ইত্যাদি কিছুতেই তাঁকে ছাড়তে রাজি নয়, যদিও “ধর্মশালা পাহাড়ে যাইয়া শরীর অনেক সুস্থ হইয়াছে।”
কাশ্মীর থেকে (৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৭) স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে স্বামীজি সুখবর পাঠাচ্ছেন, “এবার শরীর অনেক সুস্থ হওয়ায় পূর্বের ভাবে পুনরায় ভ্রমণ করিব, মনস্থ করিয়াছি।”
সেই সঙ্গে রয়েছে বিপুল আর্থিক দুশ্চিন্তা : “এদেশের লোক ত এখনও এক পয়সা গাড়িভাড়া পর্যন্ত দিলে না–তাহাতে মণ্ডলী লইয়া চলা যে কি কষ্টকর বুঝিতেই পার। কেবল ঐ ইংরেজ শিষ্যদের নিকট হাত পাতাও লজ্জার কথা। অতএব পূর্বের ভাবে কম্বলবন্ত’ হইয়া চলিলাম।”
কম্বলবন্ত অবশ্যই আবার চলমান! সন্ন্যাসী চষে বেড়াতে চাইছেন সমস্ত ভারতবর্ষ, কিন্তু রোগ কিছুতেই তাকে ছাড়তে রাজি নয়।
এই সময়ে স্বামীজির শারীরিক ছবিটা এই রকম : আলমোড়া থেকে কাঠগোদাম যাবার পথে অসুস্থ স্বামীজি একদিনের জন্যে বন্দী ভীমতালে। ৯ই আগস্ট ১৮৯৭ বেরিলী পৌঁছে আবার ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত জ্বরের বেশ প্রকোপ। কিন্তু ওই সময় হাতগুটিয়ে বসে না থেকে, স্বামীজি একের পর এক বক্তৃতা করছেন, আবার এরই মধ্যে আর্যসমাজের স্বামী অচ্যুতানন্দকে বলছেন, আর পাঁচ-ছ বছরের বেশি মরজগতে থাকবেন না।
১২ আগস্ট স্বামীজি আম্বালায় উপস্থিত। এবার জ্বর নয়, কিন্তু প্রবল উদর বেদনা। তাই নিয়েই দেড়ঘণ্টা হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা করলেন স্বামীজি, কিন্তু অনাহারে রইলেন।
ধর্মশালার পথে অমৃতসরে স্বামীজি যে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তার খবর আছে, বাধ্য হয়ে তিনি টাঙ্গা-গাড়িতে মারী-তে গেলেন। সেখানেও কিন্তু স্বামীজি শয্যাশায়ী হতে রাজি নন, ভগ্ন শরীর নিয়ে স্থানীয় গুণগ্রাহীদের অনেকক্ষণ ধরে ধর্মসঙ্গীত শোনালেন।
নিজেকে যখন তিনি তিলে তিলে ক্ষয় করছেন, সেই সময় স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি লিখছেন (১১ অক্টোবর ১৮৯৭), “আজ দশ দিন পর্যন্ত সমস্ত কাজ যেন একটা ঝেকে করেছি বলে মনে হচ্ছে। সেটা শরীরের রোগ হোক বা মনেরই হোক। এক্ষণে আমার সিদ্ধান্ত এই যে, আমি আর কাজের যোগ্য নই।…তোমার উপর অত্যন্ত কটু ব্যবহার করেছি বুঝতে পারছি, তবে তুমি আমার সব সহ্য করবে জানি; ও মঠে আর কেউ নেই যে সব সইবে। তোমার উপর অধিক অধিক কটু ব্যবহার করেছি; যা হবার তা হয়েছে কর্ম! আমি অনুতাপ কি করব, ওতে বিশ্বাস নাই–কর্ম! মায়ের কাজ আমার দ্বারা যতটুকু হবার ছিল ততটুকু করিয়ে শেষ শরীর-মন চুর করে ছেড়ে দিলেন মা। মায়ের ইচ্ছা!..দু-একদিনের মধ্যে আমি সব ছেড়ে দিয়ে একলা একলা চলে যাব; কোথাও চুপ করে বাকী জীবন কাটাব। তোমরা মাপ করতে হয় করো, যা ইচ্ছা হয় করো।… আমি লড়াইয়ে কখনও পেছপাও হইনি; এখন কি…হবো? হার-জিত সকল কাজেই আছে; তবে আমার বিশ্বাস যে, কাপুরুষ মরে নিশ্চিত কৃমিকীট হয়ে জন্মায়। যুগ যুগ তপস্যা করলেও কাপুরুষের উদ্ধার নেই–আমায় কি শেষে কৃমি হয়ে জন্মাতে হবে?…আমার চোখে এ সংসার খেলামাত্র–চিরকাল তাই থাকবে। এর মান অপমান দুটাকা লাভলোকসান নিয়ে কি ছমাস ভাবতে হবে?…আমি কাজের মানুষ! খালি পরামর্শ হচ্ছে–ইনি পরামর্শ নিচ্ছেন, উনি দিচ্ছেন; ইনি ভয় দেখাচ্ছেন, তো উনি ডর! আমার চোখে এ জীবনটা এমন কিছু মিষ্টি নয় যে, অত ভয়-ডর করে হুঁশিয়ার হয়ে বাঁচতে হবে।…লড়াই করলুম কোমর বেঁধে–এ আমি খুব বুঝি; আর যে বলে কুছ পরোয়া নেই, ওয়া বাহাদুর, আমি সঙ্গেই আছি’..তাকে বুঝি, সে বীরকে বুঝি, সে দেবতাকে বুঝি।…তারাই জগৎপাবন, তারাই সংসারের উদ্ধারকর্তা। আর যেগুলো খালি বাপ রে এগিও না-ওই ভয়, ওই ভয় ডিসপেপটিকগুলো প্রায়ই ভয়তরাসে। তবে আমার মায়ের কৃপায় মনের এত জোর যে, ঘোর ডিসপেপসিয়া কখনো আমায় কাপুরুষ করতে পারবে না। কাপুরুষদের আর কি বলব, কিছুই বলবার নাই।”