.
১৮৯৬ সালের এপ্রিল মাসে আবার লন্ডনে ফিরে আসার পরে মেজভাই মহেন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বামীজির দেখা হয়। তার যে এখানেই মৃদু হলেও হার্ট অ্যাটাক হয় তার বিবরণ আমরা যথাসময়ে বিশ্বস্ত সূত্র থেকে দেবো।
এবার জাহাজে সমুদ্রপীড়া এড়াবার জন্য আমি নিজেই কিছু চিকিৎসা করেছিলাম।”
লন্ডনে স্বামীজির বিচিত্র জীবনের নানা খবরাখবর পাঠক-পাঠিকারা এই বইয়ের শুরুতে ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। আগস্ট মাসে কিছুটা ছুটি ও কিছুটা স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য স্বামীজি সুইজারল্যান্ডে উপস্থিত হয়েছেন।
সাবধানী পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন লুসার্ন থেকে স্বামীজি লিখছেন, “আমি বিশ্রী রকম সর্দিতে ভুগছি।”
মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাঁর চিন্তার শেষ নেই। মিস্টার ই টি স্টার্ডিকে স্বামীজি লিখছেন, “আশা করি রাজার কাছ থেকে মহিমের টাকা ইতিমধ্যেই তোমার জিম্মায় এসেছে। এসে থাকলেও আমি যে টীকা তাকে দিয়েছিলাম তা ফেরৎ চাই না। তুমি ওর সবটাই ওকে দিতে পার।”
১৬ই ডিসেম্বর ১৮৯৬ সালে সেবারের মতন পশ্চিমের পালা শেষ করে স্বামী বিবেকানন্দ লন্ডন ত্যাগ করলেন এবং ১৫ জানুয়ারি ১৮৯৭ কলম্বো পৌঁছলেন।
সিংহলে বিপুল অভ্যর্থনার স্রোতে এবং অবিরাম পথশ্রমে স্বামীজি যে অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন এবং তা যে ডায়াবিটিসের লক্ষণ তা যথাসময়েই জানা গেল। তার এই রোগ কোথায় প্রথম ধরা পড়লো? কলম্বো, মাদ্রাজ না কলকাতায় তা আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়। আমরা শুধু দেখছি, মাদ্রাজ থেকে জাহাজে কলকাতা আসবার সময় ডাক্তাররা তাঁকে জলের বদলে ডাব খাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং সে জন্য জাহাজে প্রচুর ডাব তুলে দিয়েছিলেন অনুরাগীরা। সত্য কথাটি হলো স্বামীজি ভাঙা শরীর নিয়েই কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন।
.
ভগ্নস্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯৬ সালের প্রারম্ভকেই অন্তিমলীলাপর্বের শুরু বলাটা বোধ হয় অন্যায় হবে না। এই পর্বের তিনটি অধ্যায়, যার প্রথমটির বিস্তার স্বামীজির স্বদেশে অবস্থিতি পর্যন্ত, দ্বিতীয় পর্যায়ের বিস্তৃতি দ্বিতীয়বার বিদেশ গমন থেকে আকস্মিক আবার ভারতে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত। তৃতীয় পর্যায়ের শেষপ্রান্তে বেলুড়ে ৪ঠা জুলাই ১৯০২ এ মহাসমাধি।
১৯শে ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ স্বামীজি কলকাতায় ফিরে এলেন আর ডাক্তারদের পরামর্শে ৮ই মার্চ তাকে দার্জিলিং যেতে হলো। এই সময় স্বামীজির গরম একেবারেই সহ্য হচ্ছে না। এর আগেও তিনি প্রচণ্ড গরমকে এড়িয়ে শরীর বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।
প্রচণ্ড গরমে তার মাথার ঘিলু যে টগবগ করে ফোটে একথা তিনি আগেই লিখেছেন। দার্জিলিঙে প্রথম দিকে স্বাস্থ্যপরিস্থিতি যে খুব উদ্বেগজনক নয় তার প্রমাণ স্বামীজি খেতড়ির রাজা অজিত সিংকে দেখবার জন্য ২১ মার্চ কলকাতায় ফিরে এলেন। মহারাজ অজিত সিং কলকাতা ত্যাগ করেন ২৬ মার্চ এবং স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে দার্জিলিঙে ফিরে যান।
মেরি হেলকে দার্জিলিঙের চিঠি (২৮ এপ্রিল ১৮৯৭), “আমার চুল গোছ গোছ পাকতে আরম্ভ করেছে এবং মুখের চামড়া অনেক কুঁচকে গেছে–দেহের এই মাংস কমে যাওয়াতে আমার বয়েস যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। [এই সময় স্বামীজির বয়স ৩৪] এখন আমি দিন দিন ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে যাচ্ছি, তার কারণ আমাকে শুধু মাংস খেয়ে থাকতে হচ্ছে–রুটি নেই, ভাত নেই, আলু নেই, এমনকি আমার কফিতে একটু চিনিও নেই!!…আমি এখন মস্ত দাড়ি রাখছি; আর তা পেকে সাদা হতে আরম্ভ হয়েছে–এতে বেশ গণ্যমান্য দেখায়।…হে সাদা দাড়ি, তুমি কত জিনিসই না ঢেকে রাখতে পারো! তোমারই জয় জয়কার।”
“ব্যারাম-ফ্যারাম দার্জিলিং-এ একেবারেই পালিয়েছে। কাল আলমোড়া নামক আর একটি শৈলাবাসে যাচ্ছি–স্বাস্থ্যোন্নতি সম্পূর্ণ করবার জন্য, কলকাতায় আলমবাজার মঠ থেকে মিসেস সারা বুলকে স্বামীজি চিঠি লিখছেন ৫ই মে ১৮৯৭।
আলমোড়া থেকে “অভিন্নহৃদয়” স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা দু সপ্তাহ পরের চিঠি (২০ মে ১৮৯৭): “জ্বরভাবটা সব সেরে গেছে। আরও ঠাণ্ডা দেশে যাবার যোগাড় দেখছি। গরমি বা পথশ্রম হলেই দেখছি লিভারে গোল দাঁড়ায়।…আজকাল মেজাজটাও বড় খিটখিটে নাই, ও জ্বরভাবগুলো সব ঐ লিভার–আমি বেশ দেখছি। আচ্ছা, ওকেও দুরস্ত বানাচ্ছি–ভয় কি?”
কলকাতা থেকে প্রিয় শশী ডাক্তারের চিঠি ও দু বোতল ওষুধ এসে গিয়েছে। ২৯ মে শশী ডাক্তারকে স্বামীজির চিঠি : “যোগেন কি লিখছে, তা হৃক্ষেপ করবে না। সে নিজেও যেমন ভয়-তরাসে, অন্যকেও তাই করতে চায়। আমি লখনৌ-এ একটি বরফির ষোল ভাগের একভাগ খেয়েছিলাম; আর যোগেনের মতে ঐ হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ।”
এবার ১ জুন স্বামী শুদ্ধানন্দকে শুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় লেখা চিঠি : “অব্যাহতবায়ুসেবনেন মিতেন ভোজনেন সমধিকব্যায়ামসেবয়া চ সুদৃঢ়ং সুদৃশ্যং চ সঞ্জাতং মে শরীর।” সেই সঙ্গে আশীর্বাদং বিবেকানন্দস্য। “মুক্তবায়ু সেবন, মিতাহার এবং যথেষ্ট ব্যায়ামের ফলে আমার শরীর বিশেষ সুদৃঢ় ও সুদৃশ্য হয়েছে।”
পরের দিন, ২রা জুন ১৮৯৭ ইংরিজিতে লেখা চিঠি মেরি হেলবয়েস্টারকে পুনরায় বিলেতে যাওয়া সম্পর্কে–”আমার চিকিৎসকরা এত শীঘ্র আমাকে কাজে নামতে দিতে নারাজ। কারণ ইউরোপে যাওয়া মানেই কাজে লাগা। তাই নয় কি? সেখানে ছুটি নিলে রুটি মেলে না। এখানে গেরুয়াকাপড়খানাই যথেষ্ট, অঢেল খাবার মিলবে।…নিদ্রা আহার ব্যায়াম এবং ব্যায়াম আহার নিদ্রা–আরও কয়েক মাস শুধু এই করে আমি কাটাতে যাচ্ছি।”