দেশে দেশে ঘুরতে ঘুরতে রাজস্থানের আলোয়ারে এসে একজন বাঙালি ডাক্তারের সঙ্গে স্বামীজির আকস্মিক পরিচয় হয়, এঁর নাম গুরুচরণ লস্কর।
ডাক্তার লস্করই স্বামীজির থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এখানেই এক মন্ত্রশিষ্য স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করেন, “তেল মাখার কি কোন উপকার আছে?”
স্বামীজি উত্তর দিলেন, “আছে বই কি! এক ছটাক তেল ভাল করে মাখলে এক পোয়া ঘি খাওয়ার কাজ করে।”
অনেক পথ পেরিয়ে মাণ্ডবীতে স্বামীজির সঙ্গে স্বামী অখণ্ডানন্দের আবার দেখা হলো। ততক্ষণে স্বামীজির স্বাস্থ্যের যে বিশেষ উন্নতি হয়েছে তা অখণ্ডানন্দের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।
অখণ্ডানন্দ দেখলেন, স্বামীজি যেন এক অপরূপ নবকলেবর প্রাপ্ত হয়েছেন। “তিনি রূপলাবণ্যে ঘর আলো করে বসে আছেন।”
.
ডাক্তারি সম্পর্কে স্বামীজির কিছু মতামত পাওয়া যাচ্ছে বেলগাঁওয়ের ফরেস্ট অফিসার হরিপদ মিত্রর বাড়িতে।
হরিপদবাবু স্বাস্থ্যের জন্য অনেকরকম ওষুধ খাচ্ছেন জেনে স্বামীজি বললেন, “যখন দেখিবে কোন রোগ এত প্রবল হইয়াছে যে শয্যাশায়ী করিয়াছে, আর উঠিবার শক্তি নাই, তখনই ওষুধ খাইবে, নতুবা নহে। স্নায়বিক দুর্বলতা প্রভৃতি রোগের শতকরা নব্বইটা কাল্পনিক…যতদিন বাঁচ আনন্দে কাটাও।”
চিকিৎসা সম্পর্কে স্বামীজির একটা স্পষ্ট মতামত পাওয়া যাচ্ছে, যদিও পরবর্তীকালে তিনি নিজেই স্নায়বিক রোগের বলি হয়েছিলেন।
অনেকদিন পরে স্যানফ্রানসিসকো থেকে ব্রহ্মানন্দকে (মার্চ ১৯০০) স্বামীজি লিখছেন, “আমি সত্য সত্য বিরাম চাই, এ রোগের নাম নিউরোসথেনিয়া–এ স্নায়ু রোগ। এ একবার হলে বৎসরকতক থাকে। তবে দু-চার বৎসর একদম বিশ্রাম হলে সেরে যায়।…এদেশ ঐ রোগের ঘর। এইখান থেকে উনি ঘাড়ে চড়েছেন। তবে উনি মারাত্মক হওয়া দূরে থাকুক দীর্ঘ জীবন দেন। আমার জন্যে ভেবো না। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে যাব।”
.
বোম্বাই থেকে জাহাজে অজানার সন্ধানে প্রথম আমেরিকা যাত্রা পর্যন্ত সময়কালে স্বামীজির স্বাস্থ্যের একটা ছবি কোনোরকমে উপস্থিত করা গেল। ১৮৯৩ সালে জুন মাসে জাহাজে তার অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্যোন্নতির খবরও আমরা পেয়ে যাচ্ছি খেতড়ির মহারাজা অজিত সিংকে লেখা চিঠি থেকে।
সৌভাগ্যবশত অপরিচিতপ্রবাসেজীবনসংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে স্বামীজির বড়রকম অসুখবিসুখের কোনো ইঙ্গিত নেই। এই সময় শরীর বিদ্রোহ করলে তার মিশন অবশ্যই ব্যর্থ হতে পারতো। নানা পথ পেরিয়ে অপরিচিত দেশে সহায়সম্বলহীন সন্ন্যাসী যে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন তার পিছনে ছিল অপরিসীম মনোবল ও অমানুষিক পরিশ্রম। বিরামহীন এই শ্রম যে ভিতরে ভিতরে স্বামীজির শরীরকে আক্রমণ করছে তা প্রকট হতে কিছু সময় লেগেছিলো। এমন যে হতে পারে তা আশঙ্কা করেই বোধ হয় কর্মযজ্ঞে স্বামীজির তাড়াহুড়ো। পরবর্তীকালে হরিমহারাজকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) স্বামীজি বলেছিলেন, “২৯ বছরের মধ্যে সব সেরে নিয়েছি।”
কিন্তু আমরা জানি ১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিশ্ববিজয়টাই তার শেষ বড় কাজ এদেশে নয়, তার থেকেও সুদূরপ্রসারী কর্মযজ্ঞ স্বদেশে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে এই কাজের গুরুত্ব ইউরোপ-আমেরিকা জয় থেকে অনেক বড়।
*
আমেরিকায় স্বামীজির শরীর ভাঙার প্রথম সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ১৮৯৬ সালের শুরু থেকে নিউ ইয়র্কে। ১৮৯৫-এর বড়দিনেও তার ছিল দুর্ধর্ষ শরীর ও অমানুষিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা। নববর্ষের চিঠিতে (মিসেস ওলি বুলকে লেখা) রয়েছে তার সমর্থন : “দৈহিক ও মানসিকভাবে আমি খুব ভাল আছি।”
কিন্তু স্বামীজির পরের চিঠিতেই (৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬) অশনিসংকেত। “আমার শরীর প্রায় ভেঙে পড়েছে। নিউ ইয়র্কে আসা পর্যন্ত আমি একরাতও ঘুমোতে পারিনি।”
এমন যে হতে পারে তা আশঙ্কা করছিলেন বিদেশী শিষ্য স্বামী কৃপানন্দ। তিনি লিখছেন, “দৈত্যর মতন পরিশ্রম করছেন বিবেকানন্দ, ঘরভাড়া, বিজ্ঞাপন, মুদ্রণ ইত্যাদির খরচ সামলাতে গিয়ে তিনি প্রায় না খেয়ে থাকছেন।” শিষ্যের আশঙ্কা স্বামীজি না অসুখে পড়ে যান।
নিষ্ঠুর আশঙ্কাটি সত্য হলো, ১৮৯৬ জানুয়ারি থেকেই স্বামীজির শরীর যখন ভাঙতে আরম্ভ করলো তখন তার বয়স মাত্র তেত্রিশ।
এই সময় একটা আজব কাণ্ড ঘটেছিল। মার্কিনী অনুরাগিণী ব্রুকলিন নিবাসিনী মিস্ এস ই ওয়ালডোকে স্বামীজি একবার বলেছিলেন, “এলেন, একটা অদ্ভুত কাণ্ড, আমি কেমন দেখতে তা আমি মনে রাখতে পারছি না, আমি আয়নার দিকে বারবাব তাকিয়ে থাকি। কিন্তু যে মুহূর্তে আমি মুখ ফিরিয়ে নিই, আমি কেমন দেখতে তা সম্পূর্ণ ভুলে যাচ্ছি।”রাল এমার্সনের আত্মীয়া এই নিষ্ঠাবতী শিষ্যাটির স্বামীজি নাম দিয়েছিলেন হরিদাসী।
মনে রাখা ভাল, ৬ ডিসেম্বর ১৮৯৫ স্বামীজি জাহাজযোগে ইউরোপ থেকে নিউ ইয়র্কে ফিরে আসেন। সমুদ্র যাত্রাটি মোটেই সুখকর হয়নি। ৮ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক থেকে স্বামীজির চিঠি : “দশদিন অতিবিরক্তিকর দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর আমি গত শুক্রবার এখানে পৌঁছেছি। সমুদ্র ভয়ানক বিক্ষুব্ধ ছিল এবং জীবনে এই সর্বপ্রথম আমি সমুদ্রপীড়ায় অতিশয় কষ্ট পেয়েছি।”
নিউ ইয়র্কে ফিরে এসে দারুণ শীতে প্রায়ই সর্দিতে ভুগতে লাগলেন স্বামীজি। “আমার ঠাণ্ডা লেগেছে”–জানুয়ারির প্রবল ঠাণ্ডায় কে কারে ব্রুকলিন ব্রিজ বারবার পেরোতে হলে অসুখটা অস্বাভাবিক নয়।