স্বামীজি বললেন, “শরীরটা ভগ্ন, বড় কষ্ট পাচ্ছি।” কালিদাসবাবুর প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজি আরও বললেন, “কি ব্যারাম তা বলতে পারি না। প্যারিসে ও আমেরিকায় অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, তারা রোগ নির্ণয় করতে পারেন নি, ব্যাধিরও প্রতিকার বা উপশম করতে পারেননি।”
স্বামীজি যখন জ্বর ও ডিসপেপসিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে প্রবলবিক্রমে নিজের অসম্পূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন তখন একবার রসিকতা করেছিলেন, “আমার অধিকাংশ রোগ পেটে। পেটের রোগগ্রস্ত লোকরা কি প্রায় নিরুৎসাহ ও বৈরাগ্যবান হয়?” সন্দেহটা যে সব সময় সত্য নয় তার চলমান প্রমাণ তিনি নিজেই। শরীর, বিশেষ করে পেটকে নো তোয়াক্কা করেই তিনি টোটো করে সমস্ত ভারত চষে বেড়িয়েছে।
আরও আশ্চর্য ব্যাপার যে মানুষ পেটের রোগকে কিছুতেই আয়ত্তে আনতে পারছেন না এবং শরীরের এই অবস্থা মনে রেখে খেতড়ির মহারাজা যাঁকে আমেরিকা যাবার সময় উচ্চ শ্রেণীর টিকিট কিনে দিলেন, তিনিই জাহাজ থেকে খেতড়িকে চিঠি লিখেছিলেন, “আগে দিনে লোটা হাতে করে ২৫ বার পায়খানা যেতে হত, কিন্তু জাহাজে আসা অবধি পেটটা বেশ ভাল হয়ে গেছে, অতবার আর পায়খানায় যেতে হয় না।” প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণেরও পেটের ব্যারাম ছিল, ভুগে ভুগে একসময় দু’খানা হাড় হয়ে গিয়েছিলেন।
জাতীয় স্বাস্থ্যের ওপর ডিসপেপসিয়া রোগের প্রতিক্রিয়া নিয়ে স্বামীজির বিরামহীন ভাবনাচিন্তা ছিল।
শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। তাঁকে স্বামীজি বলেছিলেন, “শুনেছি, পূর্ববাংলার পাড়াগেঁয়ে লোকে অম্বলের ব্যারাম কাকে বলে তা বুঝতেই পারে না।” শিষ্য : “আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের দেশে অম্বলের ব্যারাম বলিয়া কোন ব্যারাম নাই। এদেশে এসে এই ব্যারামের নাম শুনিয়াছি। দেশে দু’বেলাই মাছ ভাত খাইয়া থাকি।”
স্বামীজি; “তা খুব খাবি। ঘাসপাতা খেয়ে যত পেটরোগা বাবাজীর দলে দেশ ছেয়ে ফেলেছে।…ওসব মহাতমোগুণের…। তমোগুণের লক্ষণ : হচ্ছে আলস্য, জড়তা, মোহ, নিদ্রা এইসব।”
আর একবার একটি রোগা ছেলেকে প্রশ্ন করে স্বামীজি জানলেন সে ক্রনিক ডিসপেপসিয়ায় ভুগছে। স্বামীজির মন্তব্য : “আমাদের বাংলা দেশটা বড় সেন্টিমেন্টাল কিনা, তাই এখানে এত ডিসপেপসিয়া।”
মার্কিন মুলুক থেকে ফেরার পরে আবার যে পেটের রোগ ফিরে এসেছিল তার যথেষ্ট ইঙ্গিত স্বামীজির বিভিন্ন চিঠিতে রয়েছে। একবার আলমোড়া থেকে (মে ১৮৯৮) স্বামী ব্রহ্মানন্দকে তিনি লিখেছিলেন, “আমার শরীর অপেক্ষাকৃত অনেক ভাল, কিন্তু ডিসপেপসিয়া যায় নাই এবং পুনর্বার অনিদ্রা আসিয়াছে। তুমি যদি কবিরাজী একটা ভাল ডিসপেপসিয়ার ওষুধ পাঠাও তত ভাল হয়।”
*
পরিব্রাজক জীবনের অন্যান্য অসুখবিসুখগুলোর কথা এবার ঝটপট সেরে নেওয়া যেতে পারে।
কামারপুকুরে যাবার পথে স্বামীজির জ্বর ও ভেদবমির কথা আমরা জানি। ফিরে এসে বরানগরে তার প্রায়ই জ্বর আসত। তখন শিমুলতলায় যান, সেখানে গ্রীষ্মের আতিশয্যে উদরাময় হয়।
এরপরে ১৮৯০ সালে স্বামীজি গাজীপুরে যান পওহারী বাবার সন্ধানে। ইনি থাকতেন গঙ্গার ধারে এক দীর্ঘ সুড়ঙ্গের মধ্যে, আহার করতেন একমুঠো নিমপাতা অথবা গোটা কয়েক লঙ্কা। এইসময় দুমাস ধরে স্বামীজি কোমরের ব্যথায় ভোগেন। একই সঙ্গে তিনি যে পেটের অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন তা কারও অজানানয়।ভিক্ষালব্ধ খাদ্য তাঁর বোধহয় সহ্য হতোনা। তবে বাসস্থানে প্রচুর লেবু গাছ থাকায় তিনি যথেষ্ট লেবু খেতেন।
আলমোড়া থেকে বদরীনারায়ণের পথে, সলড়কাড় চটিতে স্বামীজি ও তার সহযাত্রী অখণ্ডানন্দ একই সঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বামীজির জ্বর এবং অখণ্ডানন্দের কাশি। সেবার তার যাত্ৰাসঙ্গী ছিলেন সারদানন্দ অখণ্ডানন্দ, কৃপানন্দ ও একজন মালবাহক।
পরিব্রাজক স্বামীজির পরবর্তী রোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে হৃষীকেশে। ওই জায়গাটি তখন ছিল ম্যালেরিয়ার অবাধ বিচরণ ভূমি। কাছাকাছি কোনো ডাক্তারও ছিলনা। স্বামীজি জ্বরে পড়লেন এবংযথাসময়ে তাবিকারে পরিণত হয়। চিকিৎসার অভাবে জীবনসংশয়।স্বামীগম্ভীরানন্দের রচনায় আমরা এই অবস্থার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা পাই : “সেদিন ক্রমাগত ঘর্মনিঃসরণের পর শরীর হিম হইয়া নাড়ী ছাড়িয়া গেল–যেন অন্তিমকাল উপস্থিত।” একজন অচেনা সাধু থলি থেকে কিঞ্চিৎমধু ও পিপুলচূর্ণ একত্রে মাড়িয়া রোগীকে ধীরে ধীরে খাওয়ালেন। “অমনি আশ্চর্য ফল ফলিল, স্বামীজি ক্ষণকালের মধ্যে চক্ষু মেলিয়া অস্পষ্টস্বরে কি যেন বলিতে লাগিলেন।”
এরপর মীরাট। অসুস্থ অখণ্ডানন্দকে দেখতে তিনি ডাক্তার ত্রৈলোক্যনাথ ঘোষের বাড়িতে গেলেন। স্বামীজি তখন খুব রোগা হয়ে গিয়েছেন। তাঁর রোগজীর্ণ শরীর দেখে অখণ্ডানন্দ চিন্তিত : “স্বামীজিকে এত রুগ্ন আমি কখনও দেখিনি, ঠিক যেন একখানি ছায়ামূর্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। মনে হয়েছিল তিনি যেন তখনও হৃষীকেশের সাংঘাতিক পীড়া থেকে উদ্ধার পাননি।”
নিজের চিকিৎসার জন্যও স্বামীজি দিন পনেরো ডাঃ ত্রৈলোক্যনাথ ঘোষের আশ্রয়ে থেকে গেলেন। জ্বরের প্রতিক্রিয়া ও পুনরাবির্ভাব প্রতিরোধের জন্য স্বামীজি তখন নিয়মিত ওষুধ খেতেন। ঠিক কতদিন মীরাটে থাকা হয়েছিল তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে, কারও মতে কয়েক সপ্তাহ, কারও ধারণা তিন মাসের অধিক কাল–অখণ্ডানন্দের স্মৃতিকথার মতে চার-পাঁচমাস। ১৮৯১ সালের জানুয়ারিতে স্বামীজি মীরাট ছেড়ে দিল্লির পথে অগ্রসর হলেন। এখানেই ডাক্তার হেমচন্দ্র সেনের কাছে। টনসিলের চিকিৎসা করানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে।