• নিদ্রাহীনতা
• অকালে চুল দাড়ি সাদা হয়ে যাওয়া
• স্নায়ু রোগ–নিউরোসথেনিয়া
• রাত্রে খাবার পর প্রচণ্ড গরম অনুভব করা
• গরম সহ্য করতে না পারা
• অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া
• সমুদ্রযাত্রা ব্যাধি বা সি-সিকনেস
• সান স্ট্রোক
• ডায়াবিটিস
• হৃদরোগ।
বিভিন্ন চিঠিপত্রে এবং স্মৃতিকথায় এইসব রোগের যৎসামান্য অথবা বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে এতো শারীরিক যন্ত্রণা নিয়েও তিনি কেমনভাবে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় এতো অল্পসময়ের মধ্যে এমন সব অবিশ্বাস্য কাজ করে গেলেন যা বহুযুগ ধরে মানুষের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করবে। যাঁরা সামান্য শারীরিক যন্ত্রণায় ব্যাকুল হয়ে কর্মবিরতির আবেদন জানান, তাঁদের কাছে স্বামীজির শরীর ও ধৈর্য এক দুয়ে রহস্য।
ব্যাধি যত মারাত্মকই হোক, অসামান্য মনোবলের অধিকারী বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন, রোগকে প্রশ্রয় দিলে তার আরদ্ধ কাজগুলো কোনোদিন সম্পূর্ণ হবে না। কিন্তু তাকে নিয়ে প্রিয় সন্ন্যাসীভ্রাতাদের সারাক্ষণের দুশ্চিন্তা।
.
১৮৯৭ সালে ২০ মে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে আলমোড়া থেকে বিবেকানন্দ যা লেখেন তা আমাদের চোখ খুলে দেয়। বুঝতে পারা যায় এই পৃথিবীতে মৃত্যুঞ্জয়ী হতে গেলে কী ধরনের মানসিকতা প্রয়োজন।
স্বামীজি তার প্রিয় গুরুভ্রাতাকে লিখছেন : “তুমি ভয় পাও কেন? ঝট করে কি দানা মরে? এই তত বাতি জ্বলল, এখনও সারারাত্রি গাওনা আছে। আজকাল মেজাজটাও বড় খিটখিটে নাই, জ্বরভাবগুলো সব ওই লিভার–আমি বেশ দেখছি। আচ্ছা, ওকেও দুরস্ত বানাচ্ছি–ভয় কি?”
দু’মাস পরে স্বামী অখণ্ডানন্দকে স্বামীজি আবার লিখছেন, “আমিও ‘ফের লেগে যা’ আরম্ভ করেছি। শরীর তো যাবেই, কুঁড়েমিতে কেন যায়? মরচে পড়ে মরার চেয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরা ঢের ভাল। মরে গেলেও হাড়ে ভেল্কি খেলবে। তার ভাবনা কি?”
যে অসুখটি প্রায় সারাজীবন স্বামীজিকে যথেষ্ট বিব্রত করেছে তার গেরস্ত নাম পেটের অসুখ। এই অসুখের শুরু শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর বরানগরের সন্ন্যাসজীবনে। এই সময়ে আজীবন সযত্নে লালিত নরেন্দ্রনাথের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন হয় এবং সেই সুযোগে নানা রকমের ব্যাধি তাকে আক্রমণ শুরু করে। কখনও রাজকীয় সুখ এবং কখনও চরম দারিদ্র্য–এই বিরতিহীন ওঠানামা বিবেকানন্দর নজর এড়ায়নি।
দ্বিতীয়বার বিদেশযাত্রার সময় মানসকন্যা নিবেদিতাকে তিনি জাহাজে বলেছিলেন, “আমার মতো মানুষেরা চরমের সমষ্টি। আমি প্রচুতম খেতে পারি, একেবারে না খেয়ে থাকতে পারি; অবিরাম ধূমপান করি, আবার তাতে সম্পূর্ণ বিরত থাকি! ইন্দ্রিয়দমনে আমার এত ক্ষমতা, অথচ ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যেও থাকি; নচেৎ দমনের মূল্য কোথায়!”
এই বৈপরীত্য সম্বন্ধে স্বামীজি আরও একবার নিবেদিতাকে চিঠি লিখেছিলেন নিউইয়র্ক থেকে : “এ জাতীয় স্নায়ুপ্রধান শরীর কখনও বা মহাসঙ্গীতসৃষ্টির উপযোগী যন্ত্রস্বরূপ হয়, আবার কখনও বা অন্ধকারে কেঁদে মরে।”
জ্বর ও পেটের গোলমালের ইতিবৃত্ত লিখতে গেলে সব দায়ই বরানগর মঠকে দেওয়া বোধ হয় যুক্তিযুক্ত হবে না।
স্বামী গম্ভীরানন্দ তার যুগনায়ক বিবেকানন্দ বইতে স্পষ্ট বলেছেন, এফ এ পড়ার সময় প্রথম বর্ষের শেষে ছাত্র নরেন্দ্রনাথ “ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হইয়া যথানিয়মে কলেজে আসিতে পারিতেন না; কাজেই নিয়মানুসারে বৎসরে যতদিন উপস্থিত থাকা আবশ্যক, তাহা সম্ভব হইল না এবং যথাকালে এফ এ পরীক্ষার অনুমতিপ্রাপ্তির বিষয়ে গোল বাধার সম্ভাবনা দেখা গেল।”
এর কিছুদিন পরেই ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ প্রিয় নরেনের শরীরের লক্ষণ পরীক্ষা করে বলেছিলেন, “তোর শরীরের সকল স্থানই সুলক্ষণাক্রান্ত, কেবল দোষের মধ্যে নিদ্রা যাইবার কালে নিঃশ্বাসটা কিছু জোরে পড়ে। যোগীরা বলেন, অত জোরে নিশ্বাস পড়িলে অল্পায়ু হয়।”
বরানগরের কঠিন কঠোর দৃশ্যগুলি ভাবীকালের জন্য অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আঁকা রয়েছে। দুর্ভাবনা ও অনাহারের ফলে, ১৮৮৭ সালের গ্রীষ্মের প্রারম্ভে, নরেন্দ্রনাথের এক উৎকট পীড়া হইল। জ্বর-বিকার বড় ভয়ের কারণ হইয়া উঠিল। ভিতরকার বড় ঘরটিতে একটি বিছানায় তাহাকে রাখা হইয়াছে; শুইয়া আছেন। চন্দ্র ডাক্তার আসিয়া ঔষধ দিয়া যাইতেছেন।…বলরামবাবু নরেন্দ্রনাথের মাতাকে সংবাদ দেওয়ায় তিনি নরেন্দ্রনাথের এক ভ্রাতাকে সঙ্গে লইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। নরেন্দ্রনাথের কিছু জ্ঞান আছে কখনও নিস্তব্ধ–অর্ধ-অজ্ঞান অবস্থায় বলিতেছেন, এখানে কেন স্ত্রীলোক ঢুকিতে দিলে? আমিই নিয়ম করলুম, আর আমার বেলায়ই নিয়ম রদ হল? বড্ড গায়ের জ্বালা, রাত্রে ব্যামো বৃদ্ধি হইল, নরেন্দ্রনাথের নাড়ীও একটু খারাপ হইল, বাবুরাম মহারাজ আর চুপ করিয়া না থাকিতে পারিয়া উচ্চৈস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। নরেন্দ্রনাথ জোর করে…অস্পষ্টস্বরে বলিতে লাগিলেন…”কাঁদিস না, আমি এখন মরব না। তুই ভয় করিসনি। আমায় ঢের কাজ করতে হবে, আমি কাজগুলো যেন চোখে দেখতে পাচ্ছি, মরবার সময় নেই।”
এই বরানগরপর্বেই নরেন্দ্রনাথের ‘গ্রেভেল স্টোন বা পাথুরির ব্যারাম ধরা পড়ে, তিনি কিছুদিন মাতুলালয়ে এসে থাকতে বাধ্য হলেন। চিকিৎসা করতে এলেন ডাঃ রাজেন্দ্রলাল দত্ত। অবিশ্বাস্য হলেও জেনে রাখুন এই। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ রোগী দেখতে যাবার সময় উপহার হিসেবে কিছু খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যেতেন। নরেনের জন্যে তিনি নতুন বাজার থেকে মস্ত একটা বেল নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর চিকিৎসায় নরেন্দ্রনাথ যন্ত্রণামুক্ত হন।