শরীর খারাপ, কিন্তু শরীরচর্চায় এই সময়েও বিশ্বাস হারাননি বিবেকানন্দ। ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি প্রিয় শিষ্যকে বলছেন, “এখনও রোজ আমি ডামবেল কষি।” দেহ ও মন সমানভাবে চলা যে। বিশেষ প্রয়োজন তা বিবেকানন্দ তার প্রিয়জনদের বারবার বলেছেন।
১৮৯৮ সালে বলরাম বসুর বাড়িতে বিনিদ্রাবেদনায় জর্জরিত স্বামীজির আরও একটা মর্মস্পর্শী ছবি পাওয়া যায়। সে সময় তাঁর খুবই ইচ্ছা হতো যে একটু ঘুম হোক, শরীরের ক্লান্তি একটু দূর হোক, মস্তিষ্ক একটু বিশ্রাম লাভ করুক।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে, চারদিকে শাঁখ বেজে উঠলো এবং স্ত্রীকণ্ঠের উলুধ্বনি শোনা গেল। “স্বামীজি বলিলেন, ‘ওরে গেরন লেগেছে–আমি ঘুমোই, তুই আমার পা টিপে দে।’ এই বলিয়া একটুকু তন্দ্রা অনুভব করিতে লাগিলেন…গ্রহণে সর্বগ্রাস হইয়া ক্রমে চারিদিকে সন্ধ্যাকালের মতো তমসাচ্ছন্ন হইয়া গেল। গ্রহণ ছাড়িয়া যাইতে যখন ১৫।২০ মিনিট বাকি আছে, তখন স্বামীজি উঠিয়া…শিষ্যকে পরিহাস করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘লোকে বলে, গেরনের সময় যে যা করে, সে নাকি তাই কোটিগুণে পায়; তাই ভাবলুম মহামায়া এ শরীরে সুনিদ্রা দেননি, যদি এই সময় একটু ঘুমুতে পারি তো এর পর বেশ ঘুম হবে, কিন্তু তা হ’ল না; জোর ১৫ মিনিট ঘুম হয়েছে।”
গেরনে ঘুমিয়ে সত্যিই যে স্বামীজির কিছু লাভ হয়নি তার সাক্ষী শিষ্য শরচ্চন্দ্র নিজেই। কয়েক বছর পরেও (১৯০২) বেলুড় মঠের ছবি আঁকতে আঁকতে তিনি লিখছেন, স্বামীজির ঘুম নেই বললেই চলে। রাত্রি তিনটে থেকে শয্যাত্যাগ করে উঠে বসে থাকেন।
আরও এক রাতের বর্ণনা আমাদের কাছে আছে। স্থান : বলরাম বসুর বাড়ি। সময়: ভোর সাড়ে চারটে। বিনিদ্র স্বামীজি অধৈর্য হয়ে বললেন, খিদে পেয়েছে। ভক্তিময়ী সরোজিনী সেই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে লুচি, হালুয়া, কি কি ভাজা সেই ভোররাতে তৈরি করে ফেললেন। স্বামীজি হাসতে হাসতে তুলসী মহারাজকে বললেন, “দেখছিস আমার কেমন শিষ্য?”
অসুস্থ অবস্থায় পরিবেশ যাতে স্বামীজির ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায় তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় অনুরাগী ও শিষ্যদের সে কি ব্যাকুলতা। আলমোড়ায় একসময় (১৮৯৭) যে বাড়িতে ছিলেন সেখান থেকে মেরি হেলবয়েস্টারকে স্বামীজি লিখছেন, “আমার শরীর খুবই খারাপ…আশা করি খুব শীঘ্রই সেরে উঠবো।…আলমোড়ার কোন ব্যবসায়ীর একটি চমৎকার বাগানে আছি–এর চারদিকে বহুক্রোশ পর্যন্ত পর্বত ও অরণ্য।…রোজ রাত্রে কুকুরগুলিকে বেশ কিছুটা দূরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে, যাতে তাদের চেঁচামেচিতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।
আহা! ঘুম নিয়ে কি হাহাকার। আলমোড়ার চিঠির কয়েক মাস আগে (১৮৯৬) নিউইয়র্কে বিনিদ্র রজনীতে ক্ষতবিক্ষত বিবেকানন্দ তাঁর ধীরামাতা মিসেস সারা বুলকে লিখেছেন : “আমার শরীর প্রায় ভেঙে পড়েছে। এখানে আসা পর্যন্ত আমি এবছরে একদিনও ভালভাবে ঘুমোইনি…আমার ইচ্ছে হয় মহাসমুদ্রের গভীরে গিয়ে মনের সাধে লম্বা একটা ঘুম দিই।”
প্রায় একই সময়ে বিনিদ্র বিবেকানন্দ একই কথা লিখেছেন মেরি হেলকে–”এবারের শীতে আমি একটা রাত্রিও ঘুমোতে পারিনি।”
পদ্মপলাশলোচনের কথা বলতে গিয়ে আমরা যে-চোখে ঘুম আসতে না তার আলোচনায় চলে গিয়েছিলাম। এই ঘুম না আসার রোগ ইনসোমনিয়া, চিকিৎসা মাঝে মাঝে হয়েছে, কিন্তু রোগী যে কখনও তেমন সুফল লাভ করেননি তা শতবর্ষের দূরত্ব থেকেও আমরা সহজে বলতে পারি।
*
স্বামীজির রোগজর্জরিত শরীর সম্বন্ধে আমরা নানা কথা নানা জায়গায় পড়ে থাকি, কিন্তু এ-সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা এখনও গড়ে ওঠেনি। সাধারণ পাঠকদের মনে।
আমরা শুধু জানি, তার পারিবারিক রোগ মধুমেহ বা ডায়াবিটিসের কথা এবং আরও জানি তার জীবিতকালে ডায়াবিটিসের তেমন কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। এর ফলে অ্যালোপ্যাথ, হোমিওপ্যাথ, কবিরাজ ছাড়াও বারবার দেশবিদেশের হাতুড়ে ডাক্তারদের দ্বারস্থ হয়েছেন বিবেকানন্দ, নানা আজব পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছে তাঁর শরীরের ওপরে।
এইসব চিকিৎসা ব্যবস্থায় ক্লান্ত হয়েই বোধ হয় অন্তিমপর্বে রোগের উপশম সম্পর্কে স্বামীজি বলেছেন (জুন ১৯০১), “উপকার অপকার জানিনে। গুরুভাইদের আজ্ঞাপালন করে যাচ্ছি।”
শিষ্যের মন্তব্য : “দেশী কবিরাজী ঔষধ বোধ হয় আমাদের শরীরের পক্ষে সমধিক উপযোগী।”
স্বামীজির ঐতিহাসিক উত্তর : “আমার মত কিন্তু একজন সায়ান্টিফিক চিকিৎসকের হাতে মরাও ভাল; হাতুড়ে যারা বর্তমান বিজ্ঞানের কিছুই জানে না, কেবল সেকেলে পাঁজিপুঁথির দোহাই দিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছে, তারা যদি দু-চারটে রোগী আরাম করেও থাকে, তবু তাদের হাতে আরোগ্যলাভ আশা করা কিছু নয়।”
রোগের আরও খবরাখবর নেওয়ার আগে বিবেকানন্দ-অবয়বের আরও কিছু বর্ণনা যা আমরা মেজভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তর স্মৃতি থেকে পাই, তা এইখানে লিপিবদ্ধ করে রাখলে মন্দ হয় না।
স্বামীজির পায়ের তলার সামনেটা ও পিছনটা মাটিতে ঠেকতো, একে খড়ম-পা বলে। তার পা পাতলা, সরু এবং অপেক্ষাকৃত লম্বা। হাতের আঙুল : সরু, লম্বা ও অগ্রভাগ ছুঁচলো।নখ : মুক্তার মত উজ্জ্বল ও কিঞ্চিৎ রক্তাভ। মুখ : গোল ও পুরুষ্টু। ঠোঁট : পাতলা, ইচ্ছামত দৃঢ় করতে পারতেন। নাসিকা : উন্নত–সিঙ্গি নাক। হাত : সুডৌল, সরু ও লম্বা। মাথার পিছন : চ্যাপ্টা, মাথার সামনের দিক এবং ব্রহ্মতালু; উঁচু।