.
অবয়বের যে অংশ নিয়ে দেশে বিদেশে ভক্তদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই তা হলো স্বামীজির চোখ। যাঁরাই তার কাছে এসেছেন তারা এই সম্মোহিনী আঁখিপদ্মের জয়গানে মুখর হয়েছে।
“ভেরি লার্জ অ্যান্ড ব্রিলিয়ান্ট” এই কথাটি বারবার এসে পড়েছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে ও বিভিন্ন স্মৃতিকথায়। আরও কয়েকটি দুর্লভ ইংরিজি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে : “ফ্লোয়িং, গ্রেসফুল, ব্রাইট, রেডিয়ান্ট, ফাইন, ফুল অফ ফ্ল্যাশিং লাইট।” নিন্দুকরাও প্রকারান্তরে তার চরিত্রহননের ব্যর্থচেষ্টা করে আমেরিকায় গুজব ছড়িয়েছেন–মার্কিনী মহিলারা তার আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে পতঙ্গের মতন ছুটে আসছেন না, তাঁরা আসছেন তার আঁখিপদ্মের চৌম্বকশক্তিতে।
রোমাঁ রোলাঁও স্বামীজির পদ্মপলাশলোচনের রাজকীয় মহিমা বর্ণনার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।”বুদ্ধিতে, ব্যঞ্জনায়, পরিহাসে, করুণায় দৃপ্ত প্রখর ছিল সে চোখ, ভাবাবেগে ছিল তন্ময়, চেতনার গভীরে তা অবলীলায় অবগাহন করতো, রোষে হয়ে উঠতো অগ্নিবর্ষী, সে দৃষ্টির ইন্দ্রজাল থেকে কারও অব্যাহতি ছিল না।”
স্বামীজির চোখের বর্ণনায় ভারতীয়রাও তেমন পিছিয়ে থাকেননি। শুনুন স্বামী নির্লেপানন্দের মন্তব্য : “সে আঁখির তুলনা হয় না। স্বামী সারদানন্দ একদিন মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, সে যে কি চোখ–কি আর বলবো!..একজন বলেন, তিনি যখন বলরামবাবুর হলঘরে ঘুমিয়ে থাকতেন, দেখেছি, তখনও চোখ সবটা বুজতো না। পাতায় পাতায় কখনও জোড়া লেগে মুড়তো না। শিবনেত্র–সত্য সত্য।”
এই শিবনেত্রের জয়গান বিশ্বভুবনের প্রান্তে প্রান্তে। এই নেত্ৰবহ্নি যেমন সময়ে অসময়ে সমস্ত মায়ালোককে দগ্ধ করেছে, তেমন মুগ্ধ করেছে। সত্যানুসন্ধানী ভক্তজনকে। কিন্তু এই চোখে যে ঘুম আসতো না সেই বেদনাদায়ক সত্যটুকুর সঙ্গেও আমাদের পরিচয় প্রয়োজন।
এই ঘুমের ব্যাপারে কলকাতার শশী ডাক্তারকে (ঘোষ) আলমোড়া থেকে ১৮৯৭ সালে স্বামীজি লিখেছিলেন, “জীবনে কখনও শোবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমুতে পারি না; অন্তত দু’ঘণ্টা এপাশ-ওপাশ করতে হয়। কেবলমাত্র মাদ্রাজ থেকে দার্জিলিং-এর প্রথম মাস পর্যন্ত বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসত। সেই সুলভ নিদ্রার ভাব এখন একেবারে চলে গেছে। আর আমার সেই পুরানো এপাশ ওপাশ করার ধাত এবং রাত্রে আহারের পর. গরম বোধ করার ভাব আবার ফিরে এসেছে।”
অথচ স্বামীজি যে চিরকাল বিনিদ্র থাকতেন না তার প্রমাণ তিনি নিজেই রেখে গিয়েছেন।
ছাত্রাবস্থায় কীভাবে রাত জেগে পড়াশোনা করতেন তার চমৎকার বর্ণনা স্বামীজি নিজেই দিয়েছেন, : “আমি ঘরের ভিতর বই নিয়ে বসতাম, আর পাশেই রাত্রে গরম চা বা কফি থাকতো; ঘুম পেলেই পায়ে একটি দড়ি বাঁধতাম, তারপর ঘুমে বেহুশ হয়ে পড়লে যেই পায়ের দড়িতে টান পড়তো অমনি জেগে উঠতুম।”
এই বিবেকানন্দই পরবর্তীকালে তাঁর কনিষ্ঠতম সন্ন্যাসীশিষ্য স্বামী অচলানন্দকে করুণভাবে বলেছিলেন, “বেশ, তুই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারিস? তুই যা চাস তোকে আমি তাই দেব।” অচলানন্দ আমাদের জানিয়েছেন, “তার তখন নিদ্রা বেশি হতো না। শারীরিক কষ্ট ছিল যথেষ্ট, তিনি আমাকে বললেন, জ্ঞান হওয়ার পর হতে আমি জীবনে কখনও চারঘণ্টার বেশি ঘুমোইনি। ইদানিং তো তার একেবারেই ঘুম হতো না।”
নিদ্রা বা নিদ্রাহীনতা সম্পর্কে লিখতে গেলেই বালক নরেন্দ্রনাথের নিদ্রাভ্যাস সম্বন্ধে যা প্রচলিত আছে তা মনে করিয়ে দেওয়া মন্দ নয়। তার অভ্যাস ছিল উপুড় হয়ে শোওয়া। বালিশে মাথা রাখলেই তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন না। নিদ্রার জন্য চোখ বন্ধ করলেই তিনি মধ্যে এক জ্যোতির্বিন্দু দেখতে পেতেন। পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ এই জ্যোতি দেখার কথা শুনে বলেছিলেন, ধ্যানসিদ্ধরা এই রকম জ্যোতি দেখতে পায়। এ বিষয়ে আধুনিক চিকিৎসকদের কোনো মতামত আছে কি না তা জানবার কৌতূহল হয়।
স্বদেশে এবং বিদেশে পরিভ্রমণরত বিবেকানন্দ যে কতবার অসহায়ভাবে কিছুক্ষণের নিদ্রার জন্য অপেক্ষা করছেন নানা চিঠিপত্রে তার উল্লেখ রয়েছে। পুরো বিবরণ দিতে গেলে লেখার আকার বড় বড় হয়ে যায়। যখন কোথাও কোনদিন দুদণ্ডের ঘুম হলো তা নিয়ে স্বামীজির কত না আনন্দ।
আসলে জীবনের কোনদিন কখন তিনি ঘুমোতে সফল হয়েছেন তা তাঁর স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকতো। যেমন মহাপ্রয়াণের আগের বছর মে মাসে (১৯০১) তিনি প্রিয়ভক্ত স্বামী-শিষ্য সংবাদের লেখক শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছেন, ঢাকায় নাগমশায়ের বাড়িতে যাবার কথা।”বাড়িখানি কি মনোরম–যেন শান্তি-আশ্রয়। ওখানে গিয়ে পুকুরে সাঁতার কেটে নিয়েছিলুম। তারপর, এসে এমন নিদ্রা দিলুম যে বেলা আড়াইটা। আমার জীবনে যে কয়দিন সুনিদ্রা হয়েছে, নাগ-মহাশয়ের বাড়িতে নিদ্রা তার মধ্যে একদিন।”
ভক্ত নাগ মহাশয়ের সঙ্গে ১৮৯৯ সালের প্রারম্ভে বেলুড় মঠে বিবেকানন্দর দেখা হয়েছিল। স্বামীজি : “কাজ করতে মজবুত শরীর চাই; এই দেখুন, এদেশে এসে অবধি শরীর ভাল নয়; ওদেশে বেশ ছিলুম।”
নাগমশায় উত্তর দিলেন, “শরীর ধারণ করলেই ঠাকুর বলতেন–ঘরের টেক্স দিতে হয়। রোগশোক সেই টেক্স। আপনি যে মোহরের বাক্স; ঐ বাক্সের খুব যত্ন চাই। কে করবে? কে বুঝবে? ঠাকুরই একমাত্র বুঝেছিলেন।”