১৮৯৯ সালে দ্বিতীয়বার বিদেশ যাবার সময় কলকাতায় তোলা ফটোগ্রাফে স্বামীজিকে উদ্বেগজনকভাবে শীর্ণ দেখাচ্ছে। কিন্তু লন্ডন হয়ে কয়েকমাস পরেই যখন তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় উপস্থিত হলেন, তখন ওজন আবার বেশ বেড়ে গিয়েছে।
রসিকচূড়ামণি বিবেকানন্দ তখন প্রায়ই নিজেকে ফ্যাট বা মোটকা মহারাজ বলতেন। আরও কয়েকমাস পরে বিবেকানন্দ যখন প্যারিসে হাজির হলেন তখন তার ওজন হুড়মুড় করে তিরিশ পাউন্ড কমে গিয়েছে। ব্যাপারটা মার্কিনী ভক্তদের সাবধানী নজর এড়ায়নি।
প্যারিস থেকে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড তার বান্ধবী সারা বুলকে লিখছেন, “ওজন কমে যাওয়ায়, স্বামীজিকে বালকের মতন দেখাচ্ছে।” মার্কিনী ভক্তরা স্বামীজির বিভিন্ন ফটো দেখে আরও কিছু বিশ্লেষণ করেছেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় ভোলা ছবিগুলোতে তাকে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর দেখাচ্ছে। “উল্লেখযোগ্যভাবে হ্যাঁন্ডসাম”, এই শব্দটি তার সম্পর্কে ব্যবহার করা হয়েছে।
এ-বিষয়ে আরও আলোচনার আগে, বিবেকানন্দর ওজন ও অবয়ব নিয়ে আরও এক সরল মন্তব্যের আনন্দ উপভোগ করা যেতে পারে। প্রথমবার আমেরিকা থেকে ফিরে স্বামীজি অসুস্থ অবস্থায় কিছুদিন আলমোড়ায় ছিলেন। সেখান থেকে মেরি হেলবয়েস্টারকে তিনি লিখছেন, “…চিকিৎসকের ব্যবস্থামতো আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে সরলোলা দুধ খেতে হয়েছিল, আর তার ফলেই আমি পিছনের চেয়ে সামনের দিকে বেশি এগিয়ে গিয়েছি। যদিও আমি সবসময়ই আগুয়ান–কিন্তু এখনই এতোটা অগ্রগতি চাই না, তাই দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”
স্বামীজির বিদেশি জীবনীকাররা মোটামুটি একমত যে তাঁর ওজনের ওঠানামা কখনই আয়ত্তে আনা যায়নি, যদিও মাঝে মাঝে তিনি খাওয়া দাওয়া বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে দিতেন। তথ্যাভিজ্ঞদের মতে, ঐতিহাসিক শিকাগো বক্তৃতার সময় (১৮৯৩) তার ওজন মোটেই বাড়তির দিকে ছিল না, কিন্তু সম্ভবত তার পরেই ওজন স্বামীজির বাড়তে থাকে।
এর কিছুদিন পরেই মিস্টার হেলের বাড়িতে একটা ঘরে তোলা ছবিতে স্বামীজিকে বেশ মোটাসোটা দেখাচ্ছে, যদিও ক্যামেরা অনেকসময় দৃষ্টিবিভ্রম ঘটিয়ে মোটাকে রোগা এবং রোগাকে মোটা দেখাতে পারে। তবে এই সময় বল্টিমোরের এক সাংবাদিক তাঁর লেখায় ইঙ্গিত করেন, স্বামীজির ওজন ২২৫ পাউন্ড হবে।
কেমন ছিল স্বামীজির গায়ের রঙ? রোমাঁ রোলার বর্ণনা অনুযায়ী অলিভ। মনে হয় উজ্জ্বল গৌর বলতে পশ্চিমীরা যা বোঝেন তা তাকে বলা চলে না। এবিষয়ে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ একটি চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করেছেন। স্বামীজির দেহের রঙের পরিবর্তন ঘটতো–কোনদিন মনে হত একটু ময়লা, কোনদিন আরও ফরসা, কিন্তু সবসময় তাতে একটু আভা দেখা যেত যাকে সোনালি বলা চলে। স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ আরও জানিয়েছেন, তার “হস্তদ্বয় যে কোন নারীর হস্তের তুলনায় সুন্দর ছিল।”
বিবেকানন্দের শরীরের রঙ সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত–”কালোও নন প্রচণ্ড ফর্সাও নন”, “অলিভ”, “বেশ চাপা”, “লাইট”,”মুখে স্বাভা” ইত্যাদি, যা এতোদিন পরে ঠিকমতন আন্দাজ করা বোধ হয় সম্ভব নয়। তবে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ যে পরিবর্তনের কথা বলেছেন তা বেশ নির্ভরযোগ্য।
স্বামীজির মুখের আকার সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তোলা বিভিন্ন ফটোগ্রাফ কিছুটা দৃষ্টিবিভ্রম ঘটায়–বোঝা যায় কেন অনেকে তাঁর পরিপুষ্ট গোল মুখের কথা বলেছেন। আবার কারও নজর কেড়ে নিয়েছে তার শক্তিময় চিবুক।
স্বামীজির ঘন চুলের ঐশ্বর্য সম্পর্কে কিছু ধারণা কয়েকটা ছবি থেকে আমরা পাই। কোকড়া নয়, ঢেউ খেলানো বাবরি চুলের অরণ্য। এই ঘন কালো চুলের সামান্য একটু অংশ আচমকা মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউড একবার কেটে নিয়ে তার অস্বস্তির সৃষ্টি করেছিলেন। সেই চুলের অংশটুকু স্বর্ণালঙ্কারে ঢুকিয়ে মিস্ ম্যাকলাউড় সারাক্ষণ নিজের কাছে রাখতেন। দেশে ফিরে এসে বেলুড়মঠে মস্তক মুণ্ডনের সময়েও স্বামীজি নিজের চুল নিয়ে রসিকতা করেছেন। অমন সুন্দর চুল যা বিদেশে বক্তৃতাকালে কপাল পেরিয়ে প্রায় চোখের ওপর এসে পড়তো তা স্বদেশে ফিরে এসেই তিনি ফেলে দিলেন।
আমরা জানি বেলুড়মঠে তিনি প্রতি মাসে মস্তক মুণ্ডন করতেন। বেলুড় মঠে মাথা কামাচ্ছেন, যখন নাপিত চুলগুলো তাল পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, তখন তিনি সহাস্য মন্তব্য করলেন, “ওরে দেখছিস কি! এরপরে বিবেকানন্দর একগোছা চুলের জন্য ওয়ার্লডে ‘ক্ল্যামার’ পড়ে যাবে।”
নরেন্দ্র-অবয়ব সম্বন্ধে যখন নানা তথ্য একত্রিত করছি তখন বলে রাখি তাঁর ছিল ট্যাপারিং ফিঙ্গার’, বাংলায় মহেন্দ্রনাথ দত্ত যাকে চাপারকলি আঙুল বলেছেন। এই ধরনের আঙুল দ্বিধাশূন্য নিশ্চয়াত্মিক মানসিকতার ইঙ্গিত দেয়। তার নখ ছিল ঈষৎ রক্তবর্ণাভ এবং নখের মাথাটি ছিল ঈষৎ অর্ধচন্দ্রাকার। সংস্কৃতে এই দুর্লভ নখকে নখমণি’ বলে।
মহেন্দ্রনাথতার দাদারপদবিক্ষেপসম্বন্ধেওইঙ্গিত রেখেগিয়েছে–অতি দ্রুত বা অতি শ্লথ ছিল না, যেন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থেকে বিজয়াকাঙ্ক্ষায় অতি দৃঢ় সুনিশ্চিতভাবে ভূপৃষ্ঠে পদবিক্ষেপ করে চলতেন।
বক্তৃতা দেবার সময়ে বিবেকানন্দ ডান হাতের আঙুল প্রথমে সংযত করে হঠাৎ ছড়িয়ে দিতেন। মনে যেমন যেমন ভাব উঠতে “অঙ্গুলি সঞ্চালনও তদনুরূপ হইত।”