সুবিশাল যৌথপরিবারে বিবাহিতা হয়েও বিপদের সময় সহায়সম্বলহীন মেয়ের পাশে কেউ নেই, স্বামী প্রয়াত, উপার্জনের পথ নেই, জ্যেষ্ঠপুত্ৰ সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, মধ্যমটি নিজের খেয়ালে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায় এবং ছোটটি সাবালক হয়েই স্বদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে জড়িত হয়ে প্রথমে জেলে গিয়ে ঘানি টানা এবং মুক্তি পেয়ে আবার গ্রেপ্তার হবার আশঙ্কায় চুপিচুপি বেনামে দেশছেড়ে পালিয়ে দীর্ঘকাল স্বেচ্ছানির্বাসিত। এই কঠিনসময়ে আদরের ভুবনেশ্বরীর পাশে যিনি সবসময় ছিলেন এবং প্রয়োজনে কন্যাকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। বিবেকানন্দ-মাতামহী রঘুমণি। পরম বৈষ্ণব এই মহিলা তার কন্যার দেহাবসান পর্যন্ত বেঁচেছিলেন এবং ১৯১১ সালে ভুবনেশ্বরীকে মরণসাগরের ওপারে পার করে দিয়ে, ঠিক একদিনের ব্যবধানে দেহরক্ষা করেন। মেনিনজাইটিস রোগে ভুবনেশ্বরীর মৃত্যু ২৫ জুলাই ১৯১১, আর রঘুমণির শেষ বিদায় ২৭ জুলাই। তার মৃত্যুকালীন বাসস্থান নিমতলা গঙ্গাযাত্রী নিবাস। আপনজন বলতে মহেন্দ্রনাথ, ঘাটের রেজিস্টারে নাতির সই আছে। ভূপেন্দ্রনাথের বইতে দিনগুলি সম্পর্কে একটু পার্থক্য আছে। আমরা কর্পোরেশন রেকর্ডের উল্লেখ করলাম।
মামা নেই, কিন্তু বিলুর মামাবাড়ি আছে। মাতৃ-আলয়েই অসহায়া ভুবনেশ্বরীকে সপরিবারে বারবার আশ্রয় নিতে হয়েছে। এই মামার বাড়িতেই ছিল ভুবনেশ্বরীর প্রাণবন্ত জ্যেষ্ঠপুত্রের নিত্য আনাগোনা। অনেক হৃদয়স্পর্শী ঘটনার সাক্ষী রামতনু বসু লেনের এই মাতুলালয়। প্রথম পর্বে এই বাড়ির আরেকজন বসবাসকারিণী বিবেকানন্দর ঝিমা (প্রমাতামহী) রাইমণি দেবী, স্বামী মারা যাওয়ার পরে তিনি নিজ কন্যা রঘুমণির কাছেই বাস করতেন।
পিতৃদেব বিশ্বনাথের জীবনযাত্রার ওপর সামান্য আলোকপাত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিফল হয়ে তিনি আইনব্যবসায়ে মনোনিবেশ করেন এবং সেই সঙ্গে নীলামে সম্পত্তি কিনে সময়মতো তা বেচে দিয়ে তিনি অর্থবান হতেন। এই কেনাবেচায় তিনি স্ত্রী ভুবনেশ্বরীর নাম ব্যবহার করতেন।
বিশ্বনাথের কাকা কালীপ্রসাদের দুই ছেলে–একজনের নাম কেদারনাথ এবং অপরজন তারকনাথ। তারকনাথ কলকাতা হাইকোর্টে নামী উকিল হয়েছিলেন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারী সেরেস্তার অনেক মামলা-মোকদ্দমা তিনি করতেন এবং সেই সুবাদে রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বিশেষ পরিচয় ছিল। তারকনাথের ছয় কন্যা এবং তাদেরই কারও বিয়েতে ঠাকুরপরিবারের বিশিষ্ট সদস্যরা (রবীন্দ্রনাথ সহ) গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলেন। বিশিষ্ট অতিথিদের বসাবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়েছিল। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের তখনও নাম হয়নি।
তারকনাথের বিধবা, অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী-পুত্রদের খুড়িমাকে কেন্দ্র করেই বিরাট মামলার সূত্রপাত। মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে খুড়িমা জ্ঞানদাসুন্দরী সর্বস্বহারা হয়ে শেষজীবনে বিবেকানন্দর সাহায্যপ্রার্থিনী হন। এমনই ভবিতব্যের রসিকতা, যাঁর খামখেয়ালিপনায় ভুবনেশ্বরীর সোনার সংসার দুঃস্থ হলো, তিনিই আবার আশ্রয় চাইলেন ভুবনেশ্বরীর সংসারত্যাগী সন্তানের কাছে। স্বামীজির দেহাবসানের পর খুড়িমা যে বেলুড়ে নরেনকে দেখতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তার বিবরণও আমাদের হস্তগত হয়েছে।
শরিকদের সঙ্গে মামলার সময় বিবেকানন্দর পিতার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে নানা ইঙ্গিত ওঠে। কারও অভিযোগ তিনি বিশাল দেনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং পাওনাদারদের এড়াবার জন্যে কিছুদিনের জন্য কলকাতা ছেড়ে রায়পুরে প্র্যাকটিস করেন। জ্যেষ্ঠপুত্র নরেন্দ্রনাথের রায়পুরের পথে মাংস রান্না করা এবং বৈষ্ণবী দিদিমার প্রভাবে নিরামিষাশী মধ্যমভ্রাতাকে জোর করে মাংস খাওয়ানোর চেষ্টার চমৎকার একটা দৃশ্য মহেন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় আমাদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন।
রায়পুর থেকে উত্তর ভারতের কয়েকটি জায়গায় বিভিন্ন সময়ে বিশ্বনাথের ওকালতির যে ছবি আমরা পাই তাতে তিনি যে ব্রীফলেস উকিল ছিলেন তা মোটেই মনে হয় না। নরেন্দ্রনাথের বয়স যখন চোদ্দ (১৮৭৭) তখন বিশ্বনাথ রায়পুরে ছিলেন এবং কয়েকমাস পরে নিজের পরিবারের সবাইকে তিনি রায়পুরে নিয়ে যান। মেট্রোপলিটান ইস্কুলে পড়াশোনা ছেড়ে দেড় বছর নরেন্দ্রনাথ রায়পুরে ছিলেন এবং ১৮৭৯ সালে কলকাতায় এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। পরের বছর ১৮৮০ সালের ২৭ জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথ দশ টাকা ভর্তি ফি দিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই বেতনের রসিদেরছবি ভূপেন্দ্রনাথের বইতে মুদ্রিত হয়েছে।
প্রচুর উপার্জনের সঙ্গে প্রচুর বেহিসেবী ব্যয়ের ব্যাপারে অনেক উকিল এবং ডাক্তার এদেশে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গিয়েছে। বিশ্বনাথ দত্ত বেশি রোজগার না কম রোজগার করেছেন তা নিয়ে মাথাব্যথার কোনো কারণ থাকতো না যদি না তার মৃত্যুর পরে শরিকী মামলায় তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের বউ আদালতে অভিযোগ করতেন যে ভুবনেশ্বরীর ভূসম্পত্তি সবই তার স্বামী তারকনাথের উপার্জিত অর্থে বেনামে যৌথপরিবারের ভ্রাতৃবধূ ভুবনেশ্বরীর নামে কেনা হয়েছিল। এসব সম্পত্তি কেনার কোনো আর্থিক সঙ্গতিইনাকি ছিল না ভুবনেশ্বরীর স্বামীর। এমনকি বিশ্বনাথের অনুপস্থিতিতে কলকাতায় স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের ভরণপোষণ হয়েছে খুডোর পয়সায়।