সেই সঙ্গে মহাবৈরাগ্য অবস্থায় স্বামীজির চিঠি, “আমি অতি অকৃতী সন্তান, মাতার কিছু করিতে পারিলাম না, কোথায় তাদের ভাসিয়ে দিয়ে চলিয়া আসিলাম।” করুণ স্বরে তিনি যেন মায়ের কাছে ক্ষমা চাইছেন।
অবশ্য সবটাই অন্যায়বোধ নয়, অন্য এক জায়গায় সংসারত্যাগ সম্বন্ধে স্বামীজি বলছেন, যখন সংসার ছাড়লাম তখন আমার একচোখে শোকা, মা, দিদিমা, ভাই বোনদের ছেড়ে চলে যেতে ভীষণ খারাপ লাগছিল, কিন্তু দ্বিতীয় চোখে আমার আদর্শের জন্যে আনন্দাশ্রু।
.
সিমলার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তবাড়ি যাঁরা নিজের চোখে দেখেছেন তারা অবশ্যই জানেন দরিয়াটনার দত্তরা কলকাতা শহরে আদি যুগ থেকে বেশ জাঁকিয়ে বসেছিলেন। দক্ষিণরাঢ়ি কাশ্যপগোত্রীয় দত্তদের বিপুল বৈভবের পিছনে ছিল বংশানুক্রমে আইনব্যবসায় সাফল্য। কৌতূহলীরা ভূপেন্দ্রনাথ দত্তর পারিবারিক বর্ণনা পড়ে দেখতে পারেন এবং কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন কেন বিবেকানন্দ আইন পড়েছিলেন, কেন এটর্নি অফিসে শিক্ষানবিশী করেছিলেন, অথচ মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ বিলেতে আইন পড়তে হাজির হয়েছে শুনে কেন তিনি বেজায় বিরক্ত হয়েছিলেন।
উকিল ও এটর্নির গুষ্টি বলতে যা বোঝায় তা এই সিমলের দত্তরা। এই যৌথ পরিবারের সমৃদ্ধি অবশ্যই ওকালতি থেকে, আবার পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমায় সর্বস্ব হারানোর দুর্ভাগ্যও জুটেছে এঁদের। জ্ঞাতিদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমায় কলকাতার ধনবানরা একসময় কীভাবে নিঃস্ব হতেন তার অনেক ইতিহাস হাইকোর্টের এটর্নিপাড়ার কাগজপত্তরের মধ্যে চাপা পড়ে আছে। এক্ষেত্রে আমাদের দুঃখ এই কারণে যে অনাবশ্যক শরিকী লড়াই সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর স্বল্পপরিসর জীবনকে সবদিক থেকে বিষময় করে তুলেছিল। এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা না থাকলে হয়তো তিনি আরও কিছুদিন বাঁচতেন। এ-বিষয়ে যথাসময়ে একটা স্পষ্ট অথচ অস্বস্তিকর ছবি এই লেখায় হাজির করবার প্রয়োজন হবে।
দত্তদের আদি নিবাস বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার দত্ত-দরিয়াটনা বা দেরেটনা গ্রাম। দক্ষিণরাঢ়ী কাশ্যপ গোত্রীয় রামনিধি দত্ত তার পুত্র রামজীবন এবং পৌত্র রামসুন্দরকে নিয়ে গড়-গোবিন্দপুরে (কলকাতা) চলে আসেন। দেওয়ান রামসুন্দরের পাঁচ ছেলে, জ্যেষ্ঠ রামমোহন। ইনিই নরেন্দ্রনাথের প্রপিতামহ। দেখা যাচ্ছে বিলুর প্রপিতামহ রামমোহন দত্ত সুপ্রীম কোর্টের ফার্সী আইনজীবী ছিলেন। অভিজাত জীবনযাপন করেও তিনি প্রভূত অর্থ ও সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন সালকিয়ায় তার দুটো বাগানবাড়ি এবং খিদিরপুরে প্রচুর জমিজমা ছিল। অতি অল্পবয়সে (৩৬) কলেরায় রামমোহনের মৃত্যু হয়। সে সময় গ্রীষ্মকালে কলেরা হতো এবং উত্তর কলকাতায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রায় প্রত্যেক পরিবার থেকে প্রত্যেক বছর এক-আধজন মারা যেতেন।
রামমোহন মৃত্যুর সময়ে বাড়িতে এক বিধবা কন্যা ও দুটি শিশুপুত্রসন্তান রেখে যান। রামমোহন দত্তর বড় ছেলে দুর্গাপ্রসাদ, বিবেকানন্দর পিতামহ। তিনিও এটর্নি অফিসে যুক্ত ছিলেন এবং কোনো এক দুর্ঘটনায় তার জীবনের গতি পরিবর্তনের কথা আমরা ভূপেন্দ্রনাথের তথ্যপূর্ণ রচনা থেকে সংগ্রহ করেছি।
শরিকী টেনশন তখনও ছিল, কারণ যৌথ পরিবারে তাঁর স্ত্রী অপমানিত হয়েছেন এই দুঃখে দুর্গাপ্রসাদ একবার বসতবাটি ত্যাগ করেছিলেন। পরে তিনি যে সন্ন্যাসী হয়ে যান তা অনেকেরই জানা। সন্ন্যাসী হয়ে যাবার পরও দুর্গাপ্রসাদ মাঝে মাঝে টার্টু ঘোড়ায় চড়ে উত্তর ভারত থেকে কলকাতায় আসতেন এবং তাঁর এক ভিক্ষাপুত্রের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে বাস করতেন। একবার তাকে আটকাবার জন্যে দরজায় তালা লাগানো হয়, তিনদিন পরে তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে দেখা যায়, তখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গৃহত্যাগী দুর্গাপ্রসাদ আর কখনও ফেরেননি।
নরেন্দ্রপিতাবিশ্বনাথদত্ততারকাকারকরুণায় প্রায় অনাথরূপেপ্রতিপালিত হন। স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কয়েকবার ব্যবসায় নামতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তেমন সফলনা হতে পেরে একসময় (১১ এপ্রিল ১৮৫৯)এটর্নি চার্লস এফ পিটারের অধীনে আর্টিকেল ক্লার্ক হন এবং পরে (২৯ জানুয়ারি ১৮৬১) এটর্নি হেনরি জর্জ টেম্পলের অফিসে আর্টিকেল ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করেন এবং সেখানে ১০ অক্টোবর ১৮৬৪ পর্যন্ত কাজ করেন। ১৪ মার্চ ১৮৬৬ প্রধান বিচারপতি স্যার বার্নের্স পিকক-এর এজলাসে ‘এটর্নি’ ও ‘প্রক্টর’ রূপে নাম লেখাবার জন্য বিশ্বনাথ দরখাস্ত করেন। আবেদনের সঙ্গে বিশ্বনাথ দত্ত দুখানি সার্টিফিকেট দাখিল করেন–দুটি সার্টিফিকেটের তারিখ ৭ জানুয়ারি ১৮৬৫, দাতাদের নাম শ্রী গ্রীস’ চন্দ্র বনার্জি ও শ্রী ‘দিগাম্বের’ মিটার। একই দিনে এই আবেদনে সম্মতি দেন মিস্টার জাস্টিস ওয়ালটার মরগ্যান। বিচারপতি মরগ্যান পরে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রধান বিচারপতি হন। আইনপাড়ায় বিশ্বনাথের কোম্পানির নাম ছিল ধর অ্যান্ড দত্ত। তার পার্টনার আশুতোষ ধর।
ভূপেন দত্ত জানিয়েছেন, তাঁর সাহিত্যপ্রেমী পিতৃদেব একখানি উপন্যাস লিখেছিলেন এবং অর্থাভাব থাকায় বইটি পিতামহর খুড়তুতো ভাই, ডাকবিভাগের পদস্থ কর্মচারী গোপালচন্দ্র দত্তর নামে প্রকাশিত হয়। অপরের নামে নিজের রচিত গ্রন্থ প্রকাশের একই দুর্ভাগ্য পুত্র বিবেকানন্দর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। পূর্বাশ্রমে অপরের নামে এমনকি প্রকাশকের নামে তিনি বছর বেঁচেছিলেন, একমাত্র মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে নিগ্রহ, যৌথপরিবার থেকে বিতাড়ন, অনেকগুলি ছেলেমেয়ে নিয়ে অকাল-বৈধব্য, অভাবনীয় ভাগ্যবিপর্যয়, এমনকি প্রাণাধিক নাতি বিলুর অকালমৃত্যুর অসহায় সাক্ষী এই রঘুমণি দেবী। বিডন স্ট্রিটের ঘোষপরিবারের মেয়ে, পিতা গোপালচন্দ্র ঘোষ, জন্ম ১৮২৫। রঘুমণি ছিলেন পরম বৈষ্ণব।