সর্বসাকুল্যে বিবেকানন্দরা যে দশ ভাই-বোন সেকথা অনেকের খেয়াল থাকে না। আরেক মহামানব, জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথরাও পনেরো ভাই বোন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নটি পুত্র ও ছ’টি কন্যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর চতুর্দশ সন্তান। ভুবনেশ্বরীর প্রথম সন্তানটি পুত্র, অকালে মৃত্যু হওয়ায় তার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। যদিও বহুকাল পরেও জননী এই সন্তানটির অভাবনীয় সৌন্দর্যের প্রশংসা করতেন–দেখতে ছিল পিতামহের মতন। দত্তবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন একজন অজ্ঞাতনামা লেখিকার মতে প্রথম সন্তানটি আটমাস বয়সে মারা যান। এবিষয়ে অবশ্য অন্য কোন প্রমাণ সংগ্রহ সম্ভব হয়নি।
ভুবনেশ্বরীর পরের সন্তানটি কন্যা, তারও শৈশবে মৃত্যু, নাম পর্যন্ত জানা যায় না। অজ্ঞাতনামা লেখিকার মতে, এই কন্যাটি আড়াই বছর বেঁচে ছিলেন। তৃতীয় সন্তান হারামণি মাত্র ২২ বছর বেঁচে ছিলেন, এঁর সম্বন্ধেও তেমন কিছু খবর পাওয়া যায় না। চতুর্থ সন্তান স্বর্ণময়ী দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন, এক সময় স্বামীজির ভিটেতেই বসবাস করতেন। তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছেন, স্বামীজির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর দিদি স্বর্ণময়ী বেলুড়মঠে দশটাকা পাঠিয়ে দিতেন। রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্যগণ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন এই চাঁদা দেওয়া হয়েছে। এই চাঁদা দেওয়া অবশ্য শুরু করেন বিবেকানন্দ-জননী ভুবনেশ্বরী। হয় স্বামী ব্রহ্মানন্দ, না হয় স্বামী প্রেমানন্দ বাড়ি থেকে এই টাকা নিয়ে যেতেন। ভুবনেশ্বরীর পঞ্চম সন্তানটিও কন্যা–মৃত্যু ছ’বছর বয়সে। নরেন্দ্রনাথ তাঁর ষষ্ঠ সন্তান, বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৯ বছর (১৮৬৩ ১৯০২)। সপ্তম সন্তান কিরণবালা (আনুমানিক ১৮/১৯ বছর। বেঁচেছিলেন), অষ্টম যোগীন্দ্ৰবালা (বেঁচেছিলেন আনুমানিক ২৫ বছর), নবম মহেন্দ্র ও দশম ভূপেন্দ্রনাথ। শেষ দু’জন যথাক্রমে ৮৮ বছর (১৮৬৮ ১৯৫৬) এবং ৮১ বছর (১৮৮০-১৯৬১) জীবিত ছিলেন। মহেন্দ্রনাথের জন্ম-তারিখ নিয়ে অন্য মতও আছে। কর্পোরেশন জন্ম-রেজিস্টার অনুযায়ী তাঁর জন্ম ১ আগস্ট ১৮৬৯। রেজিস্টারির তারিখ ৭ আগস্ট।
ভুবনেশ্বরীর মেয়েদের পরিবারের কিছু কিছু সংবাদ বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া গেলেও, বিস্তারিত বিবরণ কোথাও নেই। বিবেকানন্দ ভিটার পুনরুদ্ধারের প্রাণান্তকর দায়িত্ব মঠ-মিশনের পক্ষ থেকে যিনি নিঃশব্দে গ্রহণ করেছেন সেই পার্থ মহারাজের (স্বামী বিশোকানন্দ) সূত্রে জানা যায়, যে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটা অধিগ্রহণের সময় বেশ কয়েকজনকে পুনর্বাসিত করা হয়, তাদের দেওয়া হয় নতুন ফ্ল্যাট–এঁরা বিবেকানন্দের বোনের দিক থেকে বংশধর, কারণ ভুবনেশ্বরীর তিন পুত্রসন্তানের কেউই বিবাহ করেননি। বিশ্বস্ত সূত্রে আরও জানা যায়, যে বোন (যোগীন্দ্ৰবালা) বিবেকানন্দের পরিব্রাজককালে সিমলা পাহাড়ে শ্বশুরবাড়িতে আত্মহত্যা করে নিজের জ্বালা জুড়িয়েছিলেন, তার দুটি নাবালিকা কন্যার দায়িত্বও একসময়ে নিঃসম্বল ভুবনেশ্বরীকে ঘাড়ে নিতে হয়। অন্য আর এক সূত্রে জানা যায়, ভুবনেশ্বরীর এই জামাতা আবার বিবাহ করলে, শোকতপ্তা মাতা ভুবনেশ্বরী নতুন বউকে এবং জামাইকে নিজের বাড়িতে এনে আদরযত্ন করেছিলেন। বাঙালি সংসারে এই ধরনের ঘটনা বিরল না হলেও, বড়ই বেদনাদায়ক। এই অভাগা দেশের অভাগিনী মায়েরাই এমন কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করেও নিজের কর্তব্য পালন করতে পারেন।
স্বামীজির বোনদের কবে কীভাবে বিয়ে হলো, পিতৃদেব বিশ্বনাথ বেঁচে থাকতে থাকতে কতটুকু দায়িত্বপালন করতে পেরেছিলেন, তাঁর আকস্মিক অকালমৃত্যুর পরে বোনদের বিবাহব্যবস্থায় দাদা নরেন্দ্রনাথের কোনো ভূমিকা ছিল কি না, এইসব ব্যাপারে বিবেকানন্দ-বিষয়ক বিপুল তথ্যসমুদ্রে তেমন কিছু খুঁটিনাটি অভিজ্ঞমহলের নজরে পড়েনি। আমরা শুধু জানি, তার বড় দুই দিদি ইংরেজি শিক্ষার আলোকলাভ করে বেথুনে পড়াশোনা করেছিলেন এবং ছোটদুই বোনওমিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদুষীহয়েছিলেন। আমরা জানি, পিতৃদেবের মৃত্যুর সময়ে বিবেকানন্দর বয়স ছিল ২১ বছর, মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রর তখন ১৫ এবং ভূপেন্দ্রনাথ নিতান্তই নাবালক, বয়স তিন।
কিরণবালা ও যোগীন্দ্ৰবালার তেমন খোঁজখবর বিবেকানন্দর বিস্তারিত জীবনকাহিনীগুলিতে আজও নেই এবং পরিবার সম্বন্ধে সর্বপ্রকার সংবাদের তুলনাহীন রসার মহেন্দ্রনাথ তাঁর প্রায় নব্বইখানি বইয়ের কোথাও এই বিষয়ে তেমনভাবে মুখ খোলেননি। কিন্তু স্বামীজির নিজের লেখা চিঠিতে মাঝে-মধ্যে কিছু উল্লেখ আছে। ১৯০০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লস্ এঞ্জেলিস থেকে মিসেস সারা বুলকে বিবেকানন্দ লিখছেন: “আমার বোনের একখানি পত্রে জানলাম যে, তার পালিতা কন্যাটি মারা গেছে। ভারতের ভাগ্যে যেন একমাত্র দুঃখই আছে। তাই হোক! সুখদুঃখে আমি যেন বোধশূন্য হয়ে গেছি!”
পরিবারের সভ্য এবং সভ্যাদের সম্পর্কে একটু বিবরণ এই জন্যে দেওয়া প্রয়োজন হলো যে মা, বোন, ভাইদের সম্পর্কে স্বামীজির কেন উদ্বেগ এবং পরিবারের পুত্র হিসেবে দায়িত্বপালনে ব্যর্থতা সম্পর্কে তাঁর মনে অন্যায়বোধ কেন তা চোখের সামনে থাকা প্রয়োজন। দশ সন্তানের জননী ভুবনেশ্বরী অকালবৈধব্যে জর্জরিত হয়েও কী বিপুল দুঃখের বোঝা আমৃত্যু নিঃশব্দে বহন করেছিলেন তা জেনে রাখাও মন্দ নয়।