পটলাদা বললেন, “বিদ্রোহী বিবেকানন্দর আগাম নমুনা আমরা কবে প্রথম দেখলাম বল তো?”
“ঠাকুর জানেন।”
“ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পাদপদ্মে তখনও আশ্রয় মেলেনি, সিমুলিয়ার তিন নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে নরেন্দ্রনাথ দত্তর বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। সংঘর্ষটা মায়ের সঙ্গে এবং রণস্থল খাওয়ার আসন। ডান হাতে খেতে খেতে বাঁ হাতে গ্লাস থেকে জল খাওয়া নিয়ে প্রবল মতবিরোধ! এঁটো হাতে গ্লাস ময়লা করার ইচ্ছে নেই নরেনের। কিন্তু সেযুগে বাঁ হাতে জল খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না, কিন্তু মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে নরেন বঙ্গীয় রীতি পাল্টালেন, আর আজকাল তো ভাতখাওয়ার সময়ে এঁটো হাতে গেলাস ধরলে মায়েরাই বকুনি দিচ্ছেন। বুঝতে পারছিস একটা পাঁচবছরের ছেলের বৈপ্লবিক গুরুত্ব? তুই-আমি সেখানে উপস্থিত থাকলে বলে দিতে পারতাম এ-ছেলে ক্ষুধানিবৃত্তির ব্যাপারে একদিন অবশ্যই হিসট্রি ক্রিয়েট করবে।”
আমাদের পটলাদাও একসময়ে নিঃশব্দে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, উপার্জনের জন্য বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। বিলেত যাওয়ার আগে পটলাদা আমাকে রসনারসিক বিবেকানন্দ-গবেষণা সম্পর্কে বহুবিধ পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “একটা নয়, অন্তত ১০৮টা পথ দিয়ে এই বিষয় মন্দিরে পৌঁছতে পারিস। এক : উনচল্লিশ বছরটা বেশ কয়েকটা পর্বে ভাগ করে নিতে পারিস। শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বে বিবেকানন্দ এক একরকম খাবারের ওপর নির্ভর করছে এবং অপরকে খাইয়েছে। পাঁচ বছর থেকে জীবনের শেষ দিন ৪ঠা জুলাই ১৯০২ পর্যন্ত রস ও রসনার কালানুপাতিক ইতিহাসটা ধাপে ধাপে উন্মোচিত হতে পারে।”
“আরও অনেক পথ আছে, যেমন আমিষ না নিরামিষ? স্বামীজির কুষ্ঠিটা একবার দেখে নিতে হবে, বিতর্কে জড়িয়ে পড়াটা ওঁর ভাগ্যে সবসময় লেখা রয়েছে, ওঁর বিরাটত্ব প্রমাণের এটাও মস্ত এক মাপকাঠি। আমিষ নিরামিষ পছন্দ না হলে রয়েছে তৃতীয় পথ; কোন স্কুলের রান্না তার পছন্দ? বাঙালি? না নবাবী? না সায়েবী? প্রত্যেকটির আবার বহু শাখা বর্ধমানি না ঢাকাই? লাহোর না লখনউ? আমেরিকান? না ফ্রেঞ্চ? না জার্মান? ইটালিয়ান? না স্প্যানিশ?”
পটলাদা একটুকরো কাগজ দেখতে দেখতে বলেছিলেন, “এই তো কলির সন্ধে! বাড়ির রান্না? না হৃষিকেশের ঝুপড়ির রান্না? না ফাঁইভস্টার মার্কিনী হোটেলের রান্না?”
আমি ঘাবড়ে যাচ্ছি কি না তা লক্ষ্য না করে পটলাদা বললেন, “ধর্মপথেও অনুসন্ধান করা যায় হিন্দু রান্না, মুসলিম রান্না, বৌদ্ধ রান্না, জৈন রান্না, চার্চের রান্না, মন্দিরের রান্না।”
“যথেষ্ট হয়েছে পটলাদা, মাত্র থার্টি নাইন ইয়ার্সে রসনার কত বৈচিত্র্যেকেই না স্বামীজি খুঁজে বেড়িয়েছেন।”
পটলাদার আশঙ্কা, “আমি কাছে না থাকলে তুই সব ভুলে যাবি, সাবজেক্টগুলো ভালভাবে ব্রেনে ঢুকিয়ে নে, স্বামীজির মতন স্মৃতিশক্তি নিয়ে তো তুই আমি এই দুনিয়ায় ভূমিষ্ঠ হইনি। যেমন ধর পূর্বদেশের রান্না? না ওয়েস্টার্ন রান্না? ঝাল, না বেঝাল? ফল না মূল? আইসক্রিম না কুলপি? লঙ্কা না গোলমরিচ? অ্যাসপারাগাস না ডেঙোর উঁটা? এসব নিতান্ত সাধারণ প্রশ্ন নয়! প্রত্যেকটার পিছনে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, বাইবেল, কোরান পর্যন্ত উঁকি মারছে।”
আমি নতমস্তকে পটলাদার বক্তব্য নিজের খাতায় নোট করে নিয়েছি। পটলাদা বললেন, “আরও দার্শনিক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে তিনি ভয় পেতেন না! অতিভোজন, না অনশন? কোনটি শ্রেয়? তুই নোট করে নে, মতলীলার শেষপর্বে এসে স্বামীজি পরামর্শ দিচ্ছেন, অতিভোজন অপেক্ষা অনশন শ্রেয়! পরমুহূর্তেই কঠিন প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবার আগেই তিনি ঘোষণা করেছেন, অনশন অপেক্ষা অর্ধভোজন যে শ্রেয় তা কারুর বলার অপেক্ষা রাখে না।”
এরপরেই পটলাদা বলেছিলেন, “অনেক পথ আমাদের দুজনকে একসঙ্গে অতিক্রম করতে হবে, কারণ খেয়ে এবং খাইয়ে অনেক বড় বড় লোক হয়ত অনেক নাম করেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে ক’জন রান্নাঘরে প্রবেশ করে শত শত রান্নার রেসিপি আবিষ্কার করেছেন? এসব সম্ভব। হয়েছে এই জন্যে যে আমাদের হিরো কখনও ধনীর দুলাল, কখনও বা ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী, কখনও বিশ্ববিজয়ী বক্তা। কখনও স্বামীজির সামনে। বিলাসবহুল হোটেলের শতপদের বুফে, আবার কখনও বা কচুপাতায় ছড়ানো ভাত ও ত্যালাকুচো পাতার ঝোল। কখনও বা স্রেফ অনাহার। এখন প্রশ্ন, কতদিন একটানা অনাহারে থাকতে হয়েছে এই মহামানবকে? ক্ষুধার সময় অন্ন না মেলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা কোথায় কোথায় তার হয়েছে? আমাদের এই কলকাতায়? না পরিব্রাজকের উত্তরাখণ্ডে? না অন্নপূর্ণার কৃপাধন্য মার্কিনদেশে?”
আমার চোখ দুটি অক্ষিগোলক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এই আশঙ্কা হওয়ামাত্রই পটলাদা বলেছিলেন, “ভয় পাসনি। যদি আবিষ্কার করতে পারিস, কোন খাবারটি বীরসন্ন্যাসীর সব চেয়ে প্রিয় ছিল, কোন জিনিসটি তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না এবং কোন অভিজ্ঞতার আলোকে স্বামীজি ঘোষণা করতে সাহস পেয়েছিলেন, ভাল সন্ন্যাসী হতে হলে ভাল রাঁধুনিও হওয়া দরকার, তা হলে আমরা দু’জনেও এই দুনিয়াতে একটু দাগ রেখে যাব।”
পটলাদা এরপরেই বলেছিলেন, “এই নোটবুকখানা সঙ্গে নিয়ে বিদেশে চলোম। যথাসময়ে অনেক খবরাখবর পাবি সূপকার বিবেকানন্দ সম্বন্ধে! তুই নিজেও থেমে যাসনে, বুঝিয়ে দিস সবাইকে, প্রাচীন ভারতে সূপকার মানে রাঁধুনি এবং একমাত্র এই দেশেই রাঁধুনি ও ঠাকুর সমার্থক শব্দ। তুই চালিয়ে যা, তারপর টুপাইস রোজগার করে আমিও তো ফিরে আসছি।”