রসগোল্লার প্রসঙ্গে হেডমাস্টার সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য মহাশয় সোজা ব্যাটে খেলেছিলেন, “শোন, স্বামী বিবেকানন্দ মিষ্টি খাওয়ার লোক ছিলেন না, তিনি যা পছন্দ করতেন তার ব্যবস্থা করলে তোমাদের চোখে জল ছাড়া কিছু থাকবে না, তার নাম লঙ্কা।”
পটলাদা পরিস্থিতিটা বুঝে গেলেন। এ বড় শক্ত ঘাঁটি, এখানে লুজ বল একেবারেই দেওয়া চলবে না। এরপরেই শ্রদ্ধেয় পটলাদাকে আমি একটা নোটবই উপহার দিয়েছিলাম, মঠমিশনের ভোজনযোগ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ মাঝেমাঝে যাতে তিনি দুটো মলাটের মধ্যে বন্দি করতে পারেন।
তথ্য সংগ্রহে নেমে নতুন নেশায় মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন পটলাদা, তার ইচ্ছে, যদি কোনোদিন ইস্কুলে ও কলেজের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সন্ন্যাসী হন, তাহলে অবশ্যই নাম নেবেন স্বামী ভোজনানন্দ। তিনি খবর পেয়েছেন, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ প্রয়োজন হলেও রামকৃষ্ণ মঠমিশনে ভোজনে তেমন কোনো বাধানিষেধ নেই। খাওয়াতে বড় ভালবাসতেন দক্ষিণেশ্বরের বড় কর্তা এবং তার প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ এবং সেই ট্রাডিশন আজও রামকৃষ্ণ মিশনের সর্বত্র অব্যাহত রয়েছে। ভক্তজনদের মধ্যে অকাতরে প্রসাদ বিতরণ করে আনন্দ পান না এমন কঠিনহৃদয় সন্ন্যাসী আমি আজ পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনে দেখিনি।
পটলাদা তার নোট বইতে অনেক কুইজ সযত্নে সংগ্রহ করে রাখতেন। একদিন ঘোষণা করলেন, “দু’খানা প্রমাণ সাইজ জিভে-গজা পুরস্কার পাবি, যদি বলতে পারিস একমাত্র কোন্ দেশে সম্রাট, সন্ন্যাসী ও সূপকার অর্থাৎ রাঁধুনিকে একই নামে ডাকা হয়?” উত্তর দিতে পারলাম না! কনসোলেসন প্রাইজ হিসেবে একখানা জিভে-গজা আমার শ্রীহস্তে অর্পণ করে পটলাদা বললেন, “ইন্ডিয়া! শব্দটা হলো মহারাজ! একমাত্র এই পবিত্র দেশে সম্রাটও মহারাজ, সন্ন্যাসীও মহারাজ, আবার রাঁধুনিও মহারাজ। বোধহয় এই কারণেই বিবেকানন্দ ছিলেন নরেন্দ্র, সন্ন্যাসী, আবার ওয়ার্লডের শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি। অনেক খোঁজখবর সংগ্রহ করতে হবে তোকে এবং আমাকে, তবে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, ওয়ার্লডের মধ্যে তিনিই একমাত্র ভারতীয় যিনি সপ্তসাগর পেরিয়ে আমেরিকায় গিয়ে বেদান্ত ও বিরিয়ানি একসঙ্গে প্রচার করবার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।”
হাওড়া বিবেকানন্দ ইস্কুলের গণ্ডি পেরোবার পরেও পটলাদা তার নোটবই ও স্বামীজি সম্পর্কে গবেষণা ত্যাগ করেননি। আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। আমি বলেছি, “খুবই কঠিন বিষয় পটলাদা। এই খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনো বইতে কোনো রেফারেন্স পাচ্ছি না, তেমন কোন খাবারের দোকানের সন্ধানও পাচ্ছি না যেখানে বিবেকানন্দ নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করতেন বা রেসিপি সংগ্রহ করতেন।”
পটলাদা প্রচণ্ড বকুনি লাগালেন। “তুই শুধু খেতেই শিখেছিস, গবেষণা করার ব্যাপারটা এখন তোকে শিখতে হবে, দোকান পাবি কোথায়? জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা স্বামীজি তো আমেরিকা এবং ইউরোপে তার আদরের ইন্ডিয়াকে প্রচার করলেন, আর এদেশে যখন ছিলেন তখন তার হাতে পয়সা কোথায়? হঠাৎ বাবা মারা যাবার পরে তো অনাহার অথবা অর্ধাহার। পরে যখন বিশ্ববিজয় করে স্বদেশে ফিরে এলেন তখন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে শরীরটা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, মণ্ডা-মিঠাই তো দূরের কথা, টানা একুশ দিন জল না খেয়ে কাটাতে হয়েছিল কবিরাজের নির্দেশে।”
“তাহলে! যে লোকের খাওয়াদাওয়াই বারণ, একখানা বরফি খেয়েছে বলে গুরুভাইরা যাঁর নামে ডাক্তারের কাছে অভিযোগ করছে এই কারণেই তার অসুখ বেড়েছে, তাকে নিয়ে কীভাবে লিখবো?”
পটলাদা কেসটা জানতেন। “বাগবাজারের এই ডাক্তারের নাম শশীভূষণ ঘোষ। এঁকে আলমোড়া থেকে বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ মিঠাই বরফি সম্পর্কে কী উত্তর দিচ্ছেন তা ধৈর্য ধরে খুঁজে বার কর। দেখবি, বিবেকানন্দ তার প্রিয় শশী ডাক্তারের কাছে নিবেদন করছেন, আমি লউ-এ একটি বরফির ষোলভাগের এক ভাগ খেয়েছিলাম, আর যোগেনের মতে (স্বামী যোগানন্দ) ঐ হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ। যোগেন যা লিখেছে তা ভ্রূক্ষেপ না করবার জন্যে ডাক্তারের কাছে। করুণ আবেদন জানাচ্ছেন আমাদের যুগাচার্য স্বামী বিবেকানন্দ।”
আমাকে অবশ্য তেমন ঘাবড়াতে দেননি পটলাদা। বলেছিলেন, “সাহস অর্জন কর, একেবারে গোড়া থেকে শুরু কর আমার মতন, ইস্কুলেই তো পড়েছিস, মর্নিং শোজ দ্য ডে, ভোরবেলাটা দেখলেই বাকি দিনটা কেমন যাবে তা বোঝা যায়।”
“তা হলে আপনি বলছেন, ভবিষ্যতেও আমার দ্বারা কিসসু হবে না, আমি চিরকালই এইরকম বোকা-বোকা থেকে যাব?”
পটলাদা বললেন, “ওরে আমরা স্বামী বিবেকানন্দর জীবন নিয়ে আলোচনা করছি, তোর-আমার লাইফ নিয়ে নয়। আমার প্রার্থনা, তুই পরিণত বয়সে ছ’সাত ভলমের একখানা জব্বর বই লিখবি ‘স্বামী বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভোজনাদি’–দেখবি বইটা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত ও গরম জিলিপির মতন বিক্রি হচ্ছে।”
“কথাটা হট কেক’!”
“রাখ তোর হট কেক, স্বামী বিবেকানন্দ পাঁউরুটিকেই সন্দেহ করতেন, তা হট কেক!”
পুরনো কথায় ফিরে এলেন পটলাদা। তিনি তখন কঁকুড়গাছির কাছে কোথায় পড়াশোনা করেন, চান্স পেলেই যোগোদ্যান, অদ্বৈত আশ্রম এবং বেলুড় মঠ ঘুরে আসেন এবং প্রবীণ সাধুদের বিশেষ প্রিয়পাত্র হিসেবে গোপন রিসার্চের কিছু কিছু খবরাখবর সংগ্রহ করে নোটবইতে লিখে ফেলেন। বিবেকানন্দকে স্বচক্ষে দেখেছেন এমন কেউ কেউ তখনও বেঁচে আছেন, তাঁদের সঙ্গে পটলাদার যোগাযোগ হয়েছে।