স্বামীজির মহাসমাধির পরে পুত্রশোকাতুরা জননীর ৯ বছর বেঁচে থাকা। এই পর্বে তার আর্থিক দায়দায়িত্ব কীভাবে মেটে?
বেণীশঙ্কর শর্মার ধারণা, খেতড়ি মহারাজের প্রতিশ্রুত মাসিক একশ টাকা অব্যাহত ছিল মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত। হওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে। সুদূর প্রবাসে ভূপেন্দ্রনাথের দায়িত্ব যে বিবেকানন্দর বিদেশি অনুরাগিণীরা গ্রহণ করেছিলেন তা স্পষ্ট। মায়ের মৃত্যুর পরও দেখছি, তাঁকে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছেন মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড। এমনকি স্বদেশে ভূপেন্দ্রনাথের একটা কাজের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। ইলিনয় থেকে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, একজন ভূতপূর্ব স্বাধীনতাসংগ্রামীকে তার ইস্কুলে চাকরি দিয়ে কীভাবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল। স্বামীজির ভাইকে চাকরি দিয়ে সাহায্য করতে পারেননি অসহায় রবীন্দ্রনাথ। তার পরামর্শ ছিল, শাসক ইংরেজের মতিগতি যতক্ষণ না পাল্টাচ্ছে ততক্ষণ আমেরিকায় শিক্ষকতা করাটাই ভূপেন্দ্রনাথের পক্ষে শ্রেয়।
নিবেদিতা চিঠি লিখেছিলেন মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউডকে। স্বামীজির অসমাপ্ত দায়দায়িত্ব গভীর ভালবাসায় নিঃশব্দে কারা নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন তার হৃদয়গ্রাহী দৃষ্টান্ত। ১৬ আগস্ট ১৯১১ : “.তোমার পাঠানো ১০ পাউন্ড এসেছে, কিন্তু এতোদিনে নিশ্চয় জেনে গিয়েছ স্বামীজির মা ইহলোকে নেই। …টাকাটা আমি ব্যাঙ্কে রেখেছি, তোমার পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। বোন এখনও ওখানে রয়েছে–অসুখের চিকিৎসা এবং দাহ খরচ ইত্যাদি যথেষ্ট, আমার আন্দাজ তুমি চাইবে এইটা শেষ অর্থ হোক। …দুদিন পরে সূর্যাস্তের সময় দিদিমাও চলে গিয়েছেন। সুতরাং ওপারে স্বামীজি তার আপনজনদের জড়ো করে নিয়েছেন।”
ওপারে আবার নিজের জনদের প্রসঙ্গ কেন? ভগিনী নিবেদিতা বোধ হয় ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। একালের বিবেকময় সন্ন্যাসী কামিনীকাঞ্চন অতি সহজে ত্যাগ করলেও, ভালবাসাকে এবং কর্তব্যকর্মকে বিসর্জন দিতে রাজি হননি। এর জন্যে বিশ্বসংসারকে তিনি তোয়াক্কা করেননি, বহুকাল আগেকার শঙ্করাচার্য ও শ্রীচৈতন্যের মতন।
গর্ভধারিণীকে আজীবন এই সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বলেই স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের বিবেকানন্দ হতে পেরেছেন। এবং হয়তো এই জন্যেই তিনি বহুদিন ধরে বহুমানুষের, বহু জননীর, বহু সন্তানের, বহু ভ্রাতার ও বহু ভগ্নীর হৃদিপদ্মাসনে নিত্য পূজিত হবেন।
স্বামীজির জীবনের কিছু বৃত্তান্ত এই লেখায় সংগ্রহ করে রাখা গেল এই বিশ্বাসে যে গর্ভধারিণী জননীকে না জানলে কোনও মানুষকে পুরো জানা যায় না।
২. সম্রাট-সন্ন্যাসী-সূপকার
গত দেড়শ বছরে এদেশের অভুক্তদের দুঃখ সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছেন কে? এই প্রশ্নের একটিই উত্তর : স্বামী বিবেকানন্দ। এই সেই মানুষ যিনি অসুস্থ এবং অনাহারি দেশবাসীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের মঠের জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে রাজি ছিলেন। পঞ্জাবের দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে সখারাম গণেশকে ও জনৈক পাহাড়ি ভদ্রলোককে তিনি বলেছিলেন, “দেশের একটি কুকুর পর্যন্ত যতক্ষণ অভুক্ত থাকবে ততক্ষণ আমার ধর্ম হবে তাকে খাওয়ানো এবং তার সেবা করা, বাকি সব অধর্ম।” আরও একবার জনৈক বেদান্তবিশারদের মুখের ওপর তিনি বলেছিলেন, “পণ্ডিতজী, যারা একমুঠো অন্নের জন্য কাতরাচ্ছে প্রথমে তাদের জন্যে কিছু করুন, তারপর আমার কাছে আসুন বৈদান্তিক আলোচনার জন্যে।”
স্বামী বিবেকানন্দর নামাঙ্কিত এক ইস্কুলে আমার পড়াশোনা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সুবাদে ১৯৪২ সাল থেকে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত স্বামীজির জীবনের একটি অল্প আলোচিত এবং অনালোকিত দিক সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ ও কিছুটা অনুসন্ধানের সুযোগ পাওয়া গিয়েছে, যদিও ইস্কুলে আমার সিনিয়র পটলাদা সেই কতদিন আগে বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ও খাওয়াদাওয়া এই বিষয়টির ব্যাপ্তি ও গভীরতা আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে তুলনীয়। পটলাদা তখনই সন্দেহ করেছিলেন, এই ধরনের গবেষণা একজীবনের কর্ম নয়, উনচল্লিশ বছরে খাওয়াদাওয়া নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বিবেকানন্দ বিশ্বভুবনকে যেভাবে কাঁপিয়ে দিয়ে গেলেন তার যথার্থ মূল্যায়ন হতে অন্তত আরও তিনশো নব্বই বছর লাগবে।
আমার তখন হতাশ অবস্থা, উঁচুক্লাসের ছাত্র পটলাদার কাছে করুণভাবে আবেদন করেছিলাম, “থ্রিনাইনটি স্কোর তো আমার হবে না!” পটলাদা বকুনি দিয়ে বলেছিলেন, “তাহলে অ্যাদ্দিনে বিবেকানন্দ থেকে কী শিখলি? দশহাজার মাইলের যাত্রাও সামান্য একটি পদক্ষেপ দিয়ে শুরু করতে হয়। চীনা দার্শনিকের উক্তি, কিন্তু স্বামীজি তো ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছে, চীনারাই একদিন সারা বিশ্বকে আলোকিত করবে, পীতযুগ আর সুদূর নয়।”
পটলাদা আরও বলেছিলেন, “স্বামীজি অ্যান্ড খাওয়াদাওয়া স্টাডিটা তোর মতন পুরুত বংশের সন্তানই শুরু করতে সাহস পাবে, কারণ এর জন্য প্রয়োজন কখনও অনাহার, কখনও অর্ধাহার ও কখনও ভূরিভোজনের। থ্রি-ইন-ওয়ান অভিজ্ঞতা।”
এতোদিন পরে আকর্ষণীয় ব্যাপারটা চেপে রেখে লাভ নেই, আমাদের ইস্কুলে শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দর স্মৃতিবিজড়িত কোনো অনুষ্ঠান হলেই ছাত্রদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা ছিল। বিশেষ আকর্ষণ-বিবেকানন্দ প্রবর্তিত ও সমর্থিত ‘দাঁড়া প্রসাদ’, যার অর্থ ভক্তদের বসিয়ে না খাইয়ে তাদের হাতে সরা অথবা মোড়ক বিতরণ করা। এইসব বিতরণকার্যে পটলাদার সবিশেষ ভূমিকা থাকতো। বিভিন্ন প্রসাদের প্রতি পটলাদার যে একটু বাড়তি দুর্বলতা ছিল তা পটলাদা কখনও চেপে রাখতেন না। কিন্তু বারবার বোঁদে খেয়ে পটলাদা স্বামীজি সম্বন্ধে কিছু গবেষণা চালিয়ে বেশ কিছু গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং আমাকে উসকে দিয়েছিলেন, “হেডমাস্টারমশায়কে বল, পর্যাপ্ত পরিমাণে রসগোল্লা খেতে পাবেন একমাত্র এই প্রত্যাশাতেই নরেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেননট বোঁদে।” পটলাদার মতে, “বোঁদেটা হলো বঙ্কিমচন্দ্রের ফেবারিট।” বিয়াল্লিশ সালের ভারতছাড়ো আন্দোলনে মিছিলে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে হাওড়ায় পুলিশের খপ্পরে পড়ে পটলাদা থানায় বলেছিলেন, “বন্দেমাতরম্ কখনোই বলিনি, আমি স্লোগান দিয়েছি বোঁদে খেয়ে মাথা গরম!”