স্বামীজির মৃত্যুর পরে এক চিঠিতে নিবেদিতা তার বিস্ময় প্রকাশ করে লিখলেন, তিনি সবকিছু গুছিয়েটুছিয়ে রেখে গেলেন। শেষ দেখার সময় আমাকে বললেন, মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে আপসে–এবিষয়ে তার কোনো খেদ নেই।
অর্থাৎ মায়ের সব সমস্যার সমাধানের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে গেলেন তার সংসারবিরাগী জ্যেষ্ঠপুত্র। যাবার আগে মাতৃইচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি-পূরণের জন্য তিনি শুধু তীর্থভ্রমণ নয়, কালিঘাটে হত্যে পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তাঁর দেহাবসানের পরেও মায়ের যাতে কষ্ট না হয়, তার জন্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গিয়েছিলেন সন্ন্যাসীভ্রাতাদের।
ভুবনেশ্বরীর কাছে স্বামী ব্রহ্মানন্দ ছিলেন সন্তানতুল্য। জ্যেষ্ঠপুত্রের অকালমৃত্যুর পরে শোকাহত জননীকে সান্ত্বনা দেবার প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ।
প্রথমদিকে রোজ এবং কিছুদিন পরে মাঝে মাঝে ভুবনেশ্বরীর কাছে। গিয়ে তার শোকের বোঝা কমাবার চেষ্টা করতেন। “কোনোদিন তার রান্না খেতেন, জননীর সাংসারিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতেন। পরিবারের অর্থ সংস্থানের সমস্যা ছাড়াও পৈতৃক ভিটা সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমার তখনও পূর্ণ মীমাংসা না হওয়াতে ঐ সব বিষয়ের দায়িত্বও স্বামী ব্রহ্মানন্দকে গ্রহণ করতে হয়।”
বিবেকানন্দজননীর শোক কিছুটা কমলে রাজা মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) ভুবনেশ্বরী দাসীকে তীর্থদর্শনে পুরী পাঠিয়ে দেন। বিবেকানন্দ জননী যতদিন বেঁচেছিলেন (১৯১১) ততদিন স্বামী ব্রহ্মানন্দ নিজের ছেলের মতন সংসারের সব ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতেন। এসব খবর স্বামী ব্রহ্মানন্দর দিনলিপিতে স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ আছে।
স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশিনী অনুরাগিণীরাও নিঃশব্দে কীভাবে চরম বিপদের দিনে তাদের প্রিয় স্বামীজির পরিবারের সভ্যদের রক্ষা করেছিলেন সেও এক দীর্ঘগল্প।
*
ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে ইংরেজের রোষানল থেকে বাঁচাবার জন্য ভগ্নী নিবেদিতা নিজে সহায়সম্বলহীনা হয়েও ২০,০০০ টাকার জামিন দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। যদিও ভূপেন্দ্রনাথ বলেছেন তার প্রয়োজন হয়নি, মাসতুতো ভাই চারুচন্দ্র মিত্র ও ডা. প্রাণকৃষ্ণ আচার্য প্রত্যেকে পাঁচহাজার টাকা করে জামিনে প্রতিভূ হয়েছিলেন।
জেল থেকে মুক্তি পাবার পরে সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে না পালালে অন্য মামলায় ভূপেন্দ্রনাথ আবার জড়িয়ে পড়তে পারেন এই গোপন খবরও সিস্টার নিবেদিতারই সংগ্রহ বলে মনে হয়।
ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, তাঁর মাতার অর্থানুকূল্যে আত্ম-পরিচয় গোপন করে তিনি বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু অভিজ্ঞমহলের ধারণা, জাহাজের টিকিটের দায়িত্ব নিবেদিতার পরম অনুগত একজন মানুষ নিয়েছিলেন। ভাগ্যে স্বামী সারদানন্দের অনুরোধে স্বামীজির তিরোধানের পনেরো দিন পরেই মহেন্দ্রনাথ দত্ত কাশ্মীর থেকে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসেছিলেন।
বিবেকানন্দের জীবনকালেও গর্ভধারিণী জননীর দায়দায়িত্ব তার পরমপ্রিয় গুরুভাই স্বামী ব্রহ্মানন্দ কেমন ভাবে পালন করতেন তার কিছু নমুনা সেকালের সন্ন্যাসীরা রেখে গিয়েছেন।
স্বামী রমানন্দ ও খ্যাতনামা ডাক্তার তাপস বসু একটি মর্মস্পর্শী ঘটনার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। স্বামী হরিহরানন্দ একবার ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্যকে বলেছিলেন : আমেরিকা থেকে ফিরেই কিছু টাকা (১০ হাজার) স্বামী ব্রহ্মানন্দর হাতে দিয়ে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, রাখাল, এই টাকাটা তুই মাকে দিয়ে আয়।
ব্রহ্মানন্দ বললেন, মাকে তোমার নিজের হাতে দেওয়া উচিত। স্বামীজি উত্তর দিলেন, না, তুই-ই দিয়ে আয়, আমি দিলে লোকে মনে করবে মা ভাইদের না-জানি কত টাকাই দিয়েছে, মঠকে আর কী দিয়েছে।
সুদূর মার্কিনী প্রবাসে ভূপেন্দ্রনাথের আশ্রয় ও লেখাপড়ার আর্থিক ব্যবস্থা কে করেছিলেন এবং কীভাবে করেছিলেন তা জানার জন্যে নিবেদিতা, সারা বুল ও মিস ম্যাকলাউডের পবিত্র জীবনকথা ধৈর্যের সঙ্গে পাঠ করা প্রয়োজন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গুরুভ্রাতা বিবেকানন্দর জননী ও তার মাকে সবসময় রক্ষা করে এসেছেন পূজনীয় সন্ন্যাসীবৃন্দ। তারা মাকে সঙ্গে নিয়ে তীর্থযাত্রাতেও বেরিয়েছে। শেষ তীর্থযাত্রা পুরীতে, ১৯১১ খ্রীস্টাব্দে।
কলকাতায় ফিরে এসে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হলেন বিবেকানন্দ গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী। তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন ডাক্তার জে কাঞ্জিলাল। দেহাবসান মঙ্গলবার ২৫ জুলাই ১৯১১। তাঁর প্রিয় পুত্র স্বর্গলোকে কী সংবাদ পেয়েছিলেন তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু আমরা জানি নিউইয়র্কে নির্বাসিত পুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথ সেদিন বিস্ময়কভাবে মায়ের মৃত্যুস্বপ্ন দেখেছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথের নিজের রচনাতেই এর স্বীকৃতি আছে।
শ্মশানে অবশ্যই উপস্থিত ছিলেন মহেন্দ্রনাথ। আর উপস্থিত ছিলেন বিবেকানন্দর মানসকন্যা নিবেদিতা। শেষ নিশ্বাস ত্যাগের কিছু আগে তিনিও বিবেকানন্দজননীর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে থেকে এই চিরদুঃখিনী রত্নগর্ভাকে স্বস্তি দিয়েছিলেন।
২৮ জুলাই ১৯১১ নিবেদিতা তার ইংরেজ বন্ধু দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক র্যাডক্লিফকে লেখেন : “দুদিন আগে স্বামীজির গর্ভধারিণী দেহরক্ষা করলেন। তাঁর ইনকারনেশন’ অবতারপর্ব শেষ হলো এক অদ্ভুত পথে। শেষনিশ্বাসের কয়েকঘন্টা আগে মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আবার তাঁকে দেখলাম শ্মশানে।”