যেহেতু আমাদের সন্ধানের বিষয়বস্তু মহামানব বিবেকানন্দ, মানবতার সর্বোচ্চ শিখরে যাঁর রোমাঞ্চকর বিজয় অভিযান, সেহেতু আমরা অবাক বিস্ময়ে এমন এক মানুষের সন্ধান করি যিনি সংসারের কঠিনতম প্রশ্নকেও এড়িয়ে না গিয়ে বৈরাগ্য ও প্রেমকে আপন বিবেকের মধ্যে সহ-অবস্থানের অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। জনৈক প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে গাজীপুরে রোদন করতে দেখে একজন মন্তব্য করলেন, “সন্ন্যাসীর পক্ষে শোকপ্রকাশ অনুচিত।” বিবেকানন্দ উত্তর দিলেন, “বলেন কি, সন্ন্যাসী হইয়াছি বলিয়া হৃদয়টা বিসর্জন দিব? প্রকৃত সন্ন্যাসীর হৃদয় সাধারণ লোকের হৃদয় অপেক্ষা আরও অধিক কোমল হওয়া উচিত। হাজার হোক, আমরা মানুষ তো বটে।” তারপর সেই অচিন্তনীয় অগ্ন্যুৎপাত–”যে সন্ন্যাসে হৃদয় পাষাণ করতে উপদেশ দেয় আমি সে সন্ন্যাস গ্রাহ্য করি না।” এদেশের শতসহস্র বছরের ইতিহাসে মনুষ্যত্বের সারসত্যটুকু এমন অকুতোভয়ে আর কেউ ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।
কিন্তু সাধারণ মানুষ আমরা, যে কোনো কঠিন তত্ত্বকে গলাধঃকরণ করতে গেলে আমরা কিছু নজির খুঁজিনজির ছাড়া এই বিশ্বে সাধারণ মানুষের কাছে কিছুই গ্রহণীয় নয়। তাই বাধ্য হয়ে বিবেকানন্দও জনমতের আদালতে নজির উপস্থিত করেছেন অষ্টম শতকের শঙ্করাচার্যের–এই শঙ্করাচার্যও নিতান্ত তরুণবয়সে সংসার ত্যাগ করেছিলেন, বেঁচেছিলেনও অত্যন্ত কম সময় (বিবেকানন্দ ৩৯, শঙ্কর ৩২), কিন্তু গর্ভধারিণী জননীর প্রতি দু’জনেরই প্রবল আনুগত্য।
জগদ্গুরু শঙ্কর মাকে ভালবাসতেন ভীষণ, তার জন্য তাকে যে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল, তার বিবরণ যথাসময়ে এই লেখায় এসে পড়বে। সেই সঙ্গে শ্রীচৈতন্যও। এখন শুধু আমরা স্মরণ করি, সত্যসন্ধানী বিবেকানন্দ দুর্জয় সাহস নিয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, “যে মাকে সত্য সত্য পূজা না করতে পারে, সে কখনও বড় হতে পারে না।” মাতৃপূজার এই দেশে নিতান্ত সাধারণ সত্যের প্রকাশ্য স্বীকৃতি, কিন্তু এযুগের সংসারে তার সরল পুনর্ঘোষণা তেমন মেলেনি। মাতৃপ্রেমী, মাতৃপূজারী, পূতচরিত্র বৈরাগীকে তাই শতাব্দীর দূরত্বে দাঁড়িয়েও প্রণাম জানাতে হয়।
বিবেকানন্দর এই দুঃসাহসিক উক্তি থেকেই আমার এবারের অনুসন্ধানের শুরু-সন্ন্যাসী ও গর্ভধারিণী। আত্মশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেও সন্ন্যাসী কেমনভাবে মাতৃপ্রেমকে অস্বীকার করতে রাজি হলেন না? মাতৃপ্রেমীদের ইতিহাসে এ বোধহয় দুর্গমতম তীর্থযাত্রা–সাধারণ মানুষের স্বপ্নেরও বাইরে। কিন্তু এ সংসারের বিবেকানন্দরা এখনও অসম্ভবকে সম্ভব করতে সক্ষম হন এবং সেই জন্যেই তারা আমাদের হৃদয়-সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং হয়ে ওঠেন আমাদের পরম পূজনীয়।
.
সন্ন্যাসী হয়ে কেউ এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হন না। বিবেকানন্দ ২৪ বছর বয়সে এবং শঙ্করাচার্য ১৬ বছর বয়সে গৃহত্যাগী হয়েছিলেন, তার আগে সংসারেই তারা পরম আদরে লালিত পালিত হয়েছেন, সুতরাং আবহমান কাল থেকে সংসারই সমাজকে সন্ন্যাসী উপহার দেয় বলাটা অত্যুক্তি হবেনা।
বিবেকানন্দ যখন বিলু বা বীরেশ্বর বা নরেন্দ্রনাথ তখনকার ছবিটা একটু চেনা না থাকলে পরবর্তী জীবনে মায়ের প্রতি, ভাইদের প্রতি, বোনদের প্রতি তার প্রবল টান এবং কর্তব্য করতে না পারার জন্য বিবেকদংশনকে ঠিক বুঝতে পারা কঠিন হতে পারে। এই বিবেকদংশন আমৃত্যু কতখানি তীব্র হয়ে উঠেছিল এবং মাতৃসেবায় আপাত ব্যর্থতাকে হৃদয়বান বিবেকানন্দর কেন পাপ মনে হয়েছে তাও আমরা ভোলামনে অনুসন্ধান করবো।
যে সংসারে বিলে অথবা নরেন্দ্রনাথের জন্ম তাকে সোনার সংসার। বলাটা অত্যুক্তি হবে না। বিলে নামটায় আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে আমরা প্রমাণ পেয়েছি, একবার বিবেকানন্দ-গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী দাসী বেলুড়মঠে এসে একতলা থেকে উঁচুগলায় বিশ্ববিজয়ী ছেলেকে ডাকলেন বিলু-উ-উ। মায়ের গলা শুনে ছেলে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন এবং নীচু গলায় মায়ের সঙ্গে কথাবার্তায় ডুবে গেলেন। এই সেই মা যিনি শৈশবে ছেলের দুরন্তপনায় অস্থির হয়ে বলেছিলেন, “চেয়েছিলাম শিবকে, পেলাম এক ভূতকে!” এসব কথা সব দেশের সব মায়েরাই তাদের ছেলেকে বলে থাকেন।
বিবেকানন্দর বিদেশি ভক্তদের মনে তাদের প্রিয় স্বামীজির গর্ভধারিণী জননী সম্বন্ধে প্রবল আগ্রহ ছিল। ইংরিজিতে আমরা বিভিন্ন রচনায় তার ইঙ্গিত পেয়েছি, তাদেরই একজন জননী ভুবনেশ্বরীর মুখে শুনেছিলেন, ছোটবেলায় এই বম্বেটে শিশুটিকে সামলানোর জন্যে একজন নয় দু’জন পরিচারিকা হিমশিম খেতো!
মায়ের কাছে চিরদিন বিলু থাকলেও, বিলে অথবা বীরেশ্বর ঠিক কবে থেকে নরেন হলেন তা আমাদের জানা নেই। তবে বীরেশ্বর নামটা যে অনেকদিন প্রচলিত ছিল তা পরবর্তীকালে সিস্টার নিবেদিতার চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি। একজন পশ্চিমী ভক্তিমতাঁকে নিবেদিতা কিছুটা উত্তেজনার সঙ্গে ‘গোপন’ খবর জানাচ্ছেন, “হৃদয়বান বিবেকানন্দর আসল নাম ‘বীরেশ্বর’ব্যাপারটা কিন্তু খুব কম লোকেই জানে।”
কথা যখন উঠলোই তখন বলে রাখা ভাল, বিলু ভুবনেশ্বরীর জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন না, যদিও পরবর্তীকালে তাকেই বড়ছেলের সমস্ত দায়িত্ব মাথায় পেতে নিতে হয়েছিল, সংসারত্যাগী হয়েও সেই বিরাট মানসিক দায়িত্বকে তিনি কোনোদিন স্বার্থপরের মতন দূরে সরিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারেননি। এই পৃথিবীতে সন্ন্যাসী অনেকেই হয়েছেন, কিন্তু পরিবার ও বৈরাগ্যের উভয়-সঙ্কট এবং তার বিস্ময়কর সমাধানই বিবেকানন্দকে বিবেকানন্দ করে তুলেছে। বিলুর আরেকটি ডাক নাম ছিল। যে মানুষটি দীর্ঘদেহী এবং পৌনে ছ’ফুট লম্বা ছিলেন তাকে তাঁর ন’ঠাকুরদাদা গোপাল দত্ত ‘বেঁটে শালা’ বলে ডাকতেন। দত্তবাড়ির পূর্বপুরুষরা আয়তনে কেমন ছিলেন তার একটা আন্দাজ করা গেল!