তার কয়েকজন বাল্যবন্ধু একদিন স্বামীজিকে বলেছিলেন, “তুমি যে ছেলেবেলায় বে করতে বললে বলতে ‘বে করব না, আমি কি হব, দেখবি, তা যা বলেছিলে তাই করলে।” স্বামীজি : “হ্যাঁ ভাই করেছি বটে। তোরা তো দেখেছিস-খেতে পাইনি, তার উপর খাটুনি। বাপ, কতই না খেটেছি।… কিন্তু ভাই ভোগ আমার অদৃষ্টে নেই। গদিতে শুলেই রোগ বাড়ে, হাঁপিয়ে মরি। আবার মেঝেয় এসে পড়ি, তবে বাঁচি।”
শেষের দিকে স্বামীজির একটি চোখ ডায়াবিটিসের প্রকোপে নষ্ট হয়েছিল।
সপ্তরথী রোগ একটি শরীরকে কেমনভাবে নানা দিক থেকে আক্রমণ করছে তার ধারাবিবরণী এই বইয়ের অন্য অধ্যায়ে পাঠক-পাঠিকাকে উপহার দেওয়া যাবে। এখন আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের শেষপর্বে উপস্থিত হওয়া যাক।
আমরা জানি, ২২ মার্চ ১৯০২ সালে সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছিল, স্বামীজির মা, দিদিমা গাড়ি করে বেলুড়ে এসেছিলেন। ১৯ জুন স্বামীজি কলকাতায় গেলেন মা এবং অপর আত্মীয়দের দেখতে। আন্দাজ করা যায়, পরের সপ্তাহে বোনের বাড়িতে মায়ের সম্পত্তি সংক্রান্ত যে ম্যারাথন আলোচনার ব্যবস্থা হয়েছিল তার প্রস্তুতিপর্ব এইদিন শেষ হয়েছিল। মিটমাটের এই আয়োজন হয়েছিল স্বামীজির জীবনের শেষ শনিবার ২৮ জুন ১৯০২।
তার আগে আর একটি মর্মস্পর্শী দৃশ্যের বর্ণনা নতুন প্রজন্মের পাঠকদের অবগতির জন্য লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন।
মিস ম্যাকলাউডের মুখেই শোনা যাক, “এপ্রিল মাসের একদিন তিনি বললেন, ‘জগতে আমার কিছুই নেই; নিজের বলতে আমার এক কানাকড়িও নেই। আমাকে যখন যা কেউ দিয়েছে তা সবই আমি বিলিয়ে দিয়েছি। আমি বললাম, স্বামীজি, যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন, ততদিন আমি আপনাকে প্রতিমাসে পঞ্চাশ ডলার দেব। তিনি মিনিটখানেক ভেবে বললেন, তাতে কুলিয়ে নিতে পারব তো? হ্যাঁ নিশ্চয় পারবেন। অবশ্য তাতে হয়তো আপনার ক্রীম-এর ব্যবস্থা হবে না’–আমি তখনই তাকে দুশ ডলার দিয়েছিলাম, কিন্তু চার মাস যেতে না যেতেই তিনি চলে গেলেন।”
*
স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপি থেকে আমরা আরও কিছু একান্ত ব্যক্তিগত খবরাখবর পাই। জানা যায় মিস ম্যাকলাউড পরে স্বামীজিকে আরও টাকা পাঠিয়েছিলেন, ঐ টাকা থেকে এবং অপরের দান থেকে স্বামীজি নিজের মাকে মাসে ১০০ টাকা এবং ভগ্নীকে ৫০ টাকা দিতেন। তখন সম্ভবত খেতড়ির দান বন্ধ ছিল।
স্বামীজির মহাপ্রয়াণের পরবর্তী দিনের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ছবি রয়েছে নিবেদিতার লেখা চিঠিতে। এমন কাব্যময় হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্যের অক্ষয় অঙ্গ হিসাবে বহুদিন বেঁচে থাকবে। আর বর্ণনা আছে ভূপেন্দ্রনাথের রচনায়।
ভূপেন্দ্রনাথের বাংলা বই ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ এবং ইংরিজি সংস্করণ ‘পেট্রিয়ট প্রফেট’ এক নয়। দুটির মধ্যেই কিছু কিছু বাড়তি খবর এখানে ওখানে লুকিয়ে আছে। ইংরিজি সংস্করণে ভূপেন্দ্রনাথ মোকদ্দমায় মা দিদিমাকে প্রধান ভূমিকা দিয়েছেন। লিখেছেন, মেয়ের মামলা চালাবার জন্যে দিদিমাকে বলরাম দে স্ট্রিটের চার কাঠা জমি বিক্রি করতে হয়। তার দুঃখ, মা তার ত্যাগের স্বীকৃতি কখনও পাননি। তিনি কেবল বিবেকানন্দ অনুরাগীদের কৌতূহলের পাত্রী ছিলেন।
শেষ সংবাদের বিবরণটুকু ইংরিজি বাংলা উভয় বই থেকে নিলে এইরকম দাঁড়ায় : এক সকালে স্বামীজির সেবক নাদু (হরেন) স্বামীজির মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে আসে। মা ও দিদিমাকে আমি খবরটা দিলাম। মা জানতে চাইলেন, হঠাৎ কী হলো? আমি বললাম, বাবার যা হয়েছিল। শোকে ভেঙে পড়ে ওঁরা কাঁদতে লাগলেন, পাড়ার একজন মহিলা এসে তাদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। নাদু আমাকে বললো সিমলা স্ট্রিটের মিত্রদের খবর দিতে। বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম আমার ভগ্নিপতি ইতিমধ্যেই খবরটা পেয়েছেন। নাদু এবং আমি বেলুড়ে রওনা দিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি স্বামীজি অন্তিম শয্যায় শয়ান। ওঁকে ঘিরে রয়েছেন মঠের সাধুরা, অতুলচন্দ্র ঘোষ এবং সিস্টার নিবেদিতা। এবার দেখলাম নাতি ব্রজমোহন ঘোষকে নিয়ে মা এলেন এবং বিলাপ করতে লাগলেন। ভূপেন্দ্রনাথের ইংরিজি বইতে আছে, সাধুরা ভূপেনকে বললেন, মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। অশ্রুসজল চোখে নিবেদিতা আমার মাকে বিদায় দিলেন। অপরাহে যখন চিতায় আগুন দেওয়া হচ্ছে তখন গিরিশচন্দ্র ঘোষ এলেন। নিবেদিতা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মাকে কেন বিদায় করা হল?” বাংলা বইতে আছে, “তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া হল।” আর ইংরিজি বইতে : “সন্ন্যাসীদের নিয়মকানুনের কিছু অংশ ওঁর কাছে ব্যাখ্যা করা হলো।”
আমরা জানি, জীবনের শেষ শনিবার, স্বামীজি বাগবাজারে তার মানসকন্যা নিবেদিতার বাড়ি গিয়েছিলেন, বোনের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন এবং তারপর উদগ্রীব হয়ে পারিবারিক বিবাদের সমাধানসূত্র খুঁজতে বসেছিলেন। জীবনের শেষ শনিবার, স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে এলেন শরিক হাবুল দত্ত। স্বেচ্ছায় বিবাদ মিটিয়ে নেবার কথা বললেন হাবুল দত্ত। স্বামীজি সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন। বললেন, যদি মীমাংসা হয় তাহলে তিনি আরও হাজার টাকা দেবেন। দুই শরিক হাবুল ও তমু দত্ত রাজি। স্বামী ব্রহ্মানন্দ তখন হাবুলের সঙ্গে পন্টুবাবু এটর্নির অফিসে গেলেন। শর্তাদি জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের এটর্নি এন সি বসুর কাছে চিঠি পাঠানো হলো। উত্তরে ওঁদের এটর্নি এন সি বসু শর্তস্বীকার করে চিঠি দিলেন। ২ জুলাই (মৃত্যুর দুদিন আগে) শান্তিরামের কাছ থেকে নিয়ে পন্টুকে (হাবুল দত্ত ও তমু দত্তর দাবি অনুযায়ী) চারশ টাকা দেওয়া হলো। অর্থাৎ শেষ হলো স্বামীজির জীবনব্যাপী আইনী সংঘাতপর্ব।