আসামের সৌন্দর্য যে স্বামীজিকে মুগ্ধ করেছিল তার প্রমাণ, অবিশ্বাস্য প্রশস্তি গেয়ে তিনি বলেছিলেন–”কাশ্মীরের পরেই আসাম ভারতের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা।” মহামূল্যবান এই উদ্ধৃতিটুকু বোধ হয় আজও আসাম পর্যটন বিভাগের নজরে পড়েনি!
.
শরীর ভাঙছে, কিন্তু তা বলে তো সন্ন্যাসীর চলার পথ রুদ্ধ হতে পারে না। এক বোন এবং মিসেস ব্যানার্জিকে নিয়ে আগস্ট মাসে স্বামীজি দার্জিলিং গিয়েছিলেন।
এই বোনটি কে? নাম পাওয়া যাচ্ছে প্রিয়ম্বদা দাসী। তাঁর পরিবারে দু’জন প্রিয়ম্বদাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর বইতে যে কবি। প্রিয়ম্বদার উল্লেখ করেছেন তিনি প্রিয়ম্বদা বসু। সেকালে দাসী লেখাটাই রেওয়াজ ছিল, স্বামীজির মাও লিখতেন ভুবনেশ্বরী দাসী।
মনে হয় দার্জিলিং-যাত্রী স্বামীজির সম্পর্কিত বোন ১২৩ মানিকতলা স্ট্রিটের প্রিয়ম্বদা ঘোষ। স্বামীজির অশেষ অনুগ্রহভাজনীয়া এবং সম্ভবত স্নেহের শিষ্যা। এই প্রিয়ম্বদা প্রায়ই বেলুড়ে আসতেন এবং স্বামীজির জন্য নানারকম খাবার তৈরি করতেন যা প্রায় সবই সেবকদের পেটে যেত!
আরও একজন বোনের সন্ধান এখনই সেরে ফেলা যাক। ইনি বড় জাগুলিয়ার দূরসম্পর্কের বোন মৃণালিনী বসু। দেহান্তের ঠিক আগে এঁর কাছেই স্বামীজি শেষ বেড়াতে গিয়েছিলেন (৬-১২ জুন ১৯০২)। গ্রামের জমিদার সর্বেশ্বর সিংহের কন্যা মৃণালিনী। তাঁর স্বামী সন্ন্যাসী হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান, ফলে তিনি সপুত্র পিত্রালয়ে বসবাস করতেন। ইনিই বেলুড়ে ফিরবার সময় ডায়াবিটিস রুগী দাদাকে এক ঝুড়ি কালজাম দিয়েছিলেন। এই জাম মঠে এনে মৃত্যুর ক’দিন আগে স্বামীজি বিপুল উৎসাহে ফারমেন্ট করে ‘সিরকা বানিয়েছিলেন।
সংসার সম্বন্ধে জীবনের শেষপ্রান্তে স্বামীজির যে বেশকিছু হতাশা ছিল তাও এখন অনুসন্ধানীদের কাছে স্পষ্ট। ভক্ত শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী একবার ঠাকুরের ভক্ত সুরেশ মিত্তিরের কথা তুলেছিলেন স্বামীজির কাছে। মঠ প্রতিষ্ঠার জন্য এঁর রেখে যাওয়া ৫০০ টাকাই একবার স্বামীজিকে ধার করতে হয়েছিল পারিবারিক মামলার জন্য। শিষ্য জিজ্ঞেস করলেন, “মহাশয়, শুনিয়াছি মৃত্যুকালে আপনারা তাহার সহিত বড় একটা দেখা করিতে যাইতেন না।”
স্বামীজির উত্তর : “যেতে দিলে তো যাব। যাক, সে অনেক কথা, তবে এইটা জেনে রাখবি, সংসারে তুই বাঁচিস কি মরিস, তাতে তোর আত্মীয়পরিজনদের বড় একটা কিছু এসে যায় না।”
“তুই যদি কিছু বিষয়-আশয় রেখে যেতে পারিস তা তোর মরার আগেই দেখতে পাবি, তা নিয়ে ঘরে লাঠালাঠি শুরু হয়েছে। তোর মৃত্যুশয্যায় আগুন দেবার কেউ নেই–স্ত্রী-পুত্র পর্যন্ত নয়। এরই নাম সংসার।”
শতসহস্র সমস্যায় জড়িত, মৃত্যুপথযাত্রী সন্ন্যাসীর বিবেকে গর্ভধারিণী জননীর প্রতি কর্তব্যবোধের অগ্নি দিবারাত্র ধিকিধিকি জ্বলছে। তার চিন্তা, দেহাবসানের পর এই স্বার্থপর সংসারে তার মাকে কে দেখবে?
২০ মার্চ ১৯০১ তারিখের একটি চিঠি নজরে পড়ে। আমাদের হিসেব অনুযায়ী স্বামীজি তখন ঢাকায়। মায়ের সঙ্গে মিলন হয় ২৫ মার্চ নারায়ণগঞ্জে।
২০ মার্চ ১৯০১-এর চিঠিতে স্বামীজির উদ্বেগ : “আমার ভাই মহিন এখন ইন্ডিয়ায়, বম্বের কাছে করাচিতে। সারদানন্দের সঙ্গে তার পত্রযোগাযোগ আছে। শুনছি সে এবার বর্মা এবং চিনে যাবে। যেসব লোক তাকে লোভ দেখাচ্ছে তাদের ঐসব জায়গায় দোকানপাট আছে। আমি ওর সম্বন্ধে মোটেই উদ্বিগ্ন নই।” এরপরেই সেই নির্মম উক্তি : “সে ভীষণ স্বার্থপর–হি ইজ এ ভেরি সেলফিশ ম্যান।”
এর আগে আমরা দেখেছি, আমেরিকান মিস্টার ফক্সের কাছে চিঠিতে স্বামীজি তাঁর ভূপর্যটক ভাইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শারীরিক যন্ত্রণায় কাতর স্বামীজি বোধ হয় তাঁর মৃত্যুর পরে মায়ের দেখাশোনার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলেন, হয়তো তিনি মানসচক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন তার দেহাবসানের পরেই ভূপেন রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে দেশছাড়া হবে, তখন কে দেখবে মাকে?
সম্প্রতি শ্রীনগর পোস্টাপিস থেকে লেখা মহিমবাবুর একটা চিঠি (২৪ এপ্রিল ১৯০২) আমাদের নজরে এসেছে। চিঠির প্রাপক স্বামী সদানন্দ, গুপ্তমহারাজ বলে যিনি পরিচিত। মহেন্দ্রনাথ লিখছেন, “যা খবর পাচ্ছি তাতে আমাকে মায়ের যত্ন নিতে হবে, তার অবস্থা মোটেই ভাল নয়। এবার আমাকে কাজ করতে হবে, রোজগার করতে হবে, যাতে তাকে ভালভাবে রাখা যায়।”
আমরা জানি ১৯০৩ থেকে ভূপেন্দ্রনাথ গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। এমনও কি হতে পারে, পরিবারের মধ্যে আরও আগে থেকে আগুন না হলেও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল?
মহিমকে হাতের গোড়ায় পাওয়া যাবে না বলেই কি স্বামীজি তাঁর পারিবারিক মামলার আগুন সম্পূর্ণ নিভিয়ে ফেলবার জন্যে এমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন?
মায়ের কথা তিনি যে কখনই ভুলছেন না তার আরও প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব। কাশী থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি লিখছেন (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯০২)–”মা দিদিমা যদি আসতে চান পাঠিয়ে দিও। এই প্লেগ আসবার সময়টা কলকাতা থেকে সরে এলেই ভাল।”
শেষ পর্বে স্বামীজির শরীরের অবস্থা আমাদের মনকে ব্যথিত করে তোলে। পা ফুলে নানা রোগের লক্ষণ, হাঁটতে কষ্ট হয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এত শিথিল ও কোমল যে টিপলেই ব্যথা লাগে। দারুণ গ্রীষ্মে কবিরাজমশাই নির্দেশ দিলেন একুশ দিন জল খাওয়া বা নুন খাওয়া চলবে না। স্বামীজি প্রবল মনোবল নিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন। শরীরের ঐ অবস্থায় আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে সানন্দে বিলিতি কায়দায় তিনি রান্নাবান্না করলেন।