একদিন ওঁদের আহারের অল্প পরে স্বামীজি হঠাৎ গিয়ে হাজির। বিশেষ ইচ্ছা মায়ের পাতের একটু প্রসাদ খান। তখন মায়ের থালায় সজনে খাড়াটুকু মাত্র অবশিষ্ট ছিল। কোনো কথায় কান না দিয়ে তাই অত্যন্ত পরিতৃপ্তি সহকারে খেলেন স্বামীজি।
*
অন্ত্যলীলা পর্বে স্বামীজির শরীরের অবস্থা যে ক্রমশই খারাপ হচ্ছে তা অনুগামীরা ভালভাবেই জানতেন।
সামান্য যেটুকু সময় অবশিষ্ট রয়েছে তার পূর্ণ ব্যবহারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। একদিকে চলেছে মঠ-মিশনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার দুর্জয় সাধনা, অন্যদিকে রামকৃষ্ণ ভাবধারাকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেবার নিরন্তর প্রচেষ্টা। সেই সঙ্গে চলেছে নতুন প্রজন্মের সাধকদলকে নবযুগের প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ। এইসব কাজ সহজ নয়, বাধাহীনও নয়। স্বামীজির সন্ন্যাসী-ভ্রাতারাও ভালবাসায় এবং আনুগত্যে তুলনাহীন। এদেশের অধ্যাত্মজীবনে বিবেকানন্দর গুরুভ্রাতারা যে নিঃশব্দ ইতিহাস রচনা করে গিয়েছেন তার প্রকৃত মূল্যায়ন আজও হয়নি।
সন্ন্যাসী-বিবেকানন্দের এক তীর্থ থেকে অন্য তীর্থে যাত্রার বিরতি নেই। এইসব তীর্থযাত্রা নিতান্ত সুগম নয়। কোথাও কোথাও দুর্গম পথের যাত্রী পথের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তবু নেই চলার বিরতি।
মায়াবতী ত্যাগ করছেন বিবেকানন্দ ১৮ই জানুয়ারি ১৯০১ এবং সেই দিনই খেতড়িরাজ অজিত সিং-এর বেদনাদায়ক এবং কিছুটা রহস্যজনক অকালমৃত্যুর সংবাদ নতুন অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত এঁকে দিল। যাঁর ওপর তিনি সবচেয়ে নির্ভরশীল ছিলেন তিনিই আর পিছনে রইলেন না। কিন্তু সন্ন্যাসীর নাইকো চলার শেষ।
বিবেকানন্দ এবার চললেন পূর্বভারতের তীর্থযাত্রায়। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের তীর্থপরিক্রমা তো নতুন কথা নয়, কিন্তু নতুন কথাটা হলো জননীর ইচ্ছাপূরণ। গুণের ছেলেরাই তো সাগ্রহে মাকে তীর্থে নিয়ে যায়।
বছরের গোড়াতেই (২৬শে জানুয়ারি) এক চিঠিতে স্বামীজি লিখছেন, “বাংলাদেশে, বিশেষত মঠে যে মুহূর্তে পদার্পণ করি, তখনি আমার হাঁপানির কষ্টটা ফিরে আসে, এস্থান ছাড়লেই আবার সুস্থ।”
স্বামীজির সানন্দ ঘোষণা: “আগামী সপ্তাহে আমার মাকে নিয়ে তীর্থে যাচ্ছি। তীর্থযাত্রা সম্পূর্ণ করতে কয়েক মাস লাগবে। তীর্থদর্শন হলো হিন্দু বিধবার প্রাণের সাধ। সারাজীবন আত্মীয়-স্বজনদের কেবল দুঃখ দিয়েছি। তাদের এই একটি ইচ্ছা অন্তত পূর্ণ করতে চেষ্টা করছি।”
নিজের মাকে নিয়ে দাক্ষিণাত্যে যাবার পরিকল্পনাও হয়েছিল, কিন্তু স্বামীজির রোগজীর্ণ শরীরই বাদ সেধেছিল।
এক সপ্তাহ নয়, মার্চের ১৮ তারিখের আগে পূর্ববঙ্গের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া সম্ভব হল না। স্বামী ব্রহ্মানন্দের ওই তারিখের দিনলিপিটি আকর্ষক। ‘আজ সন্ধ্যায় স্বামীজি, নিত্যানন্দ ও আরও পাঁচজন ঢাকায় যাত্রা করলেন।
স্বামীজির মা মঠে এসেছিলেন, বললেন ব্রহ্মপুত্রে স্নান করাতে। স্বামীজির কাছ থেকে রিপ্লাই টেলিগ্রাম এল, মাকে পাঠাতে বলেছেন।
ঢাকায় স্বামীজির ভগ্ন শরীর দেখে একজন ভক্ত জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনার শরীর এত তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল, আগে থেকে যত্ন নেননি কেন?”
স্বামীজির স্পষ্ট উত্তর : “আমেরিকায় আমার শরীরবোধই ছিল না।”
চিঠিতে স্বামীজি লিখছেন, “আমার মা ও তার সঙ্গিনীরা পাঁচদিন আগে ঢাকায় এসেছেন, ব্রহ্মপুত্রে পবিত্র স্নানের যোগে।” একই চিঠিতে স্বামীজি জননীসমা মিসেস বুলকে আমেরিকায় জানাচ্ছেন, “আমার মা ও আর সব মেয়েদের নিয়ে চন্দ্রনাথ যাচ্ছি, সেটা পূর্ব বাংলার শেষপ্রান্তে একটি তীর্থস্থান।”
ঢাকায় থাকার সময় স্বামীজি যে স্পষ্টভাবেই আসন্ন বিদায়কালের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তা এখন আমরা জানি। যখন ঢাকায় জনসভায় গম্ভীর গলায় স্বামীজি বলেছিলেন তখন ব্যাপারটার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। স্বামীজি বলেছিলেন, “আমি বড়জোর একবছর আছি। এখন শুধু মাকে গোটাকতক তীর্থ দর্শন করিয়ে আনতে পারলেই আমার কর্তব্য শেষ হয়। তাই চন্দ্রনাথ আর কামাখ্যা যাচ্ছি। তোরা কে কে আমার সঙ্গে যাবি বল? স্ত্রীলোকের উপর যাদের খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে, শুধু তারাই সঙ্গে যাবে।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপি থেকে সমর্থন পাওয়া যায়, স্বামীজির মা ও বোন কামাখ্যাদর্শনেও গিয়েছিলেন। ঢাকা ও শিলং-এ স্বামীজির স্বাস্থ্যের ঘোরতর অবনতি ঘটেছিল।
১২ই মে ১৯০১ স্বামী ব্রহ্মানন্দের ডায়রি : “রবিবার : স্বামীজি, গুপ্ত, স্বামীজির মা, বোন, খুড়ি, রামদাদার বিধবা স্ত্রী কৃষ্ণপ্রেয়সী দত্ত সকালে শিলং থেকে ফিরলেন।” গুরুপ্রাণ রামচন্দ্র দত্তের স্ত্রী কৃষ্ণপ্রেয়সীর মৃত্যু পরের বছর ১লা এপ্রিল- ক্ষয়রোগে। তার শেষ ঠিকানা ১১ মধু রায় লেন। এঁর বিয়েতেই বিলু নিতবর হয়েছিলেন। কৃষ্ণপ্রেয়সী সম্পর্কে মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার মাকে তিনি বিশেষ করিয়া সম্ভম করিতেন। এইরূপ ধীরা, নম্রা ও মিষ্টভাষিণী স্ত্রী জগতে খুব কম দেখিতে পাওয়া যায়।”
ব্রহ্মানন্দের ডায়রিতে উল্লিখিত খুড়িটিই কি আমাদের আদালতী খুড়ি? মনে হয় ইনিই জ্ঞানদাসুন্দরী দত্ত কারণ স্বামীজির দয়ার শরীর। তার শত্রু-মিত্র জ্ঞান থাকতো না। ক’দিন আগেই তিনি প্রিয় ব্রহ্মানন্দকে বলেছিলেন, “যদি একজনের মনে–এ সংসার নরককুণ্ডের মধ্যে একদিনও একটু আনন্দ ও শান্তি দেওয়া যায়, সেইটুকুই সত্য, এই তো আজন্ম ভুগে দেখছি।”