স্বামী বিবেকানন্দ কি তখনই মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন? ৭ মার্চ ১৯০০ আমেরিকা থেকে তিনি মিসেস বুলকে লিখলে, শঙ্কর প্রদর্শিত পথেই তিনি ফিরে যাচ্ছেন মায়ের কাছে। সেই সঙ্গে কেমনভাবে ফেরবার খরচ তুলবেন তার হিসেব।
“নিউইয়র্কে আমার যে হাজার ডলার আছে তার থেকে মাসে ৯ টাকা আসবে। আমি যে জমি মাকে কিনে দিয়েছি তার থেকে আসবে ৬ টাকা। যে পুরনো বাড়িটা রয়েছে তার থেকে পাওয়া যাবে মাসে ৬ টাকা। যা নিয়ে মামলা চলছে সেটা আমাদের অধিকারে নেই। মা, দিদিমা, ভাই ও আমি মাসে কুড়ি টাকায় চালিয়ে নেবো। আমি এখনই ভারতে ফিরে যেতে রাজি যদি হাজার ডলারে হাত না দিয়ে জাহাজ ভাড়াটা যোগাড় করতে পারি।”
এর পরে আবার মায়ের কথা : “সমস্ত জীবন ধরে মায়ের ওপর বিরামহীন অত্যাচার করেছি। মায়ের পুরো জীবনটাই সীমাহীন এবং বিরতিহীন দুঃখ। যদি সম্ভব হয়, শেষ চেষ্টায় আমি মাকে একটু সুখী করতে চাই। আমি পরিকল্পনাটা ছকে নিয়েছি।…”।
পাঁচদিন পরে ব্রহ্মানন্দের কাছে স্বামীজি খোঁজখবর নিচ্ছেন–দেওয়াল তুলে ছোট্ট বাড়িটাকে আলাদা করে দেওয়া খুব শক্ত কাজ নয়। যদি পারা যায় একটা ছোট্ট বাড়িতে মা ও বৃদ্ধা দিদিমার সেবা করা।
মে মাসে স্বামীজির আর একটা চিঠি থেকে দেখছি, গঙ্গার ধারে ছোট্ট মাতৃনিবাসের পরিকল্পনা স্বামীজি ত্যাগ করেছেন, পয়সা নেই বলে। টাকাকড়ির আরও হিসেব রয়েছে : “মিসেস সেভিয়ার আমাকে যে ৬০০০ টাকা দিয়েছিলেন তা আমার খুড়ি এবং খুড়তুতো বোনদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি কেনবার ৫০০০ টাকা মঠ-ফান্ড থেকে ধার করেছি। আমার খুড়তুতো বোনের কাছে আপনি যে টাকা পাঠান তা সারদানন্দ যাই বলুক বন্ধ করবেন না। এরপর স্বামীজি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন যে মঠের টাকা তার নিজের অথবা মায়ের খরচের জন্যে কখনও নেওয়া হয়নি।
বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজার সময় সঙ্ঘজননী সারদামণি স্বামীজিকে প্রধান ভূমিকা দিয়েছিলেন। গর্ভধারিণী জননীকেও স্বামীজি যে আনন্দোৎসবের সময় ভোলেননি তার প্রমাণ রয়েছে শ্রীশ্রীমায়ের স্মৃতিচিত্রে। আনন্দময়ীর আবাহনের সময় আনন্দময়ী জননীর একটা ছবি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেলুড় মঠে ভুবনেশ্বরী বেগুন তোলেন, লঙ্কা তোলেন আর এ বাগান ও বাগান ঘুরে বেড়ান। “আমার নরেন এসব করেছে”, মনের আনন্দ তিনি চেপে রাখতে পারছেন না। বিব্রত বিবেকানন্দ মাকে সামলে বললেন, “মনে করছ বুঝি তোমার নরু এসব করেছে! নয়, যিনি করবার তিনিই করেছেন, নরেন কিছু নয়।”
*
১৯০০ সালেই স্বামীজির শেষ পাশ্চাত্যলীলা। বছরের শেষপ্রান্তে আমরা তাকে দেখি অনুরাগিণী পরিবৃত হয়ে প্যারিস থেকে কনস্ট্যানটিনোপলের পথে।
মাদাম কালভে ও মিস ম্যাকলাউড সহ তিনি যখন এথেন্স হয়ে কায়রোর পথে তখন পরমবিশ্বস্ত স্বামী সারদানন্দ চিঠি লিখছেন মিসেস বুলকে–”মঠ ফান্ড থেকে স্বামীজি যা টাকা ধার নিয়েছিলেন তা শোধ করে দিয়েছেন। মামলার জন্যও তিনি বাড়তি টাকা পাঠিয়েছে।”
এই মামলা নিশ্চয় খুড়ির বিরুদ্ধে, যিনি পয়সা নিয়ে, প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিবেকানন্দ-জননীকে সম্পত্তির দখল দেননি। মঠের জন্যও তিনি কিছু টাকা নিশ্চিত করেছেন।
কায়রোতে আকস্মিক যা ঘটে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে। এখন আমাদের আলোচনার বিষয় ৯ই ডিসেম্বর ১৯০০ সালের সেই সন্ধ্যা, যখন স্বামীজি বিনা নোটিসে বেলুড়ে ফিরে এসেছিলেন এবং মঠের দেওয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে তিনি সকলের সঙ্গে খিচুড়ি খেতে বসে গিয়েছিলেন। যারা তাঁকে সেদিন দেখেছিল তারা জানতো না কোন শারীরিক দুর্যোগের তোয়াক্কা না করে বিশ্বপরিভ্রমণ বন্ধ রেখে ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে এসেছে।
ফেরার পরেই স্বামীজি যে মায়ের সংসারের খবরাখবর নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে। পাঁচ দিন পরে তিনি মিসেস ওলি বুলকে অনুরোধ করলেন, “যে টাকাটা আপনি আমার খুড়তুতো বোনের কাছে সোজাসুজি পাঠাতেন এবার সেটা আমার কাছে পাঠাবেন। আমি চেক ভাঙিয়ে, টাকা দেবার ব্যবস্থা করবো।” এই গুড়তুতো বোনকে (কাজিন) নিয়মিত টাকা দেবার ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত খুড়ির মেয়েদের কিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই বিমলহৃদয় সন্ন্যাসী।
জীবনের শেষপর্বে মা ও দিদিমার কাছে স্বামীজির যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল। স্বামীজি যেমন যেতেন মা-দিদিমার কাছে, তেমন মাঝে মাঝে মা চলে আসতেন বেলুড়ে, ডাক দিতেন বিলু-উ-উ বলে।
তাছাড়া ছেলের কাছ থেকে মাঝে মাঝে বিধবা মা-দিদিমার কাছে ফলমূল, শাকশজি উপহার যেতো।
ফিরে এসে যেবার প্রথম মামাবিহীন মামাবাড়িতে গেলেন সেবার আলোড়ন পড়ে গেল। দিদিমার বাড়িতে সবাইকে সীমাহীন আনন্দ দিতেন স্বামীজি। পাঠদ্দশায় দিদিমার বড় ন্যাওটা ছিলেন স্বামীজি। মাকে ছাড়িয়েও দিদিমা অপার্থিব সুন্দরী ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সেও তার রূপ ফেটে পড়তো। প্রিয় নাতির জন্য নানা ব্যঞ্জন প্রস্তুত হতো। দলবল নিয়ে গিয়ে স্বামীজি খেয়ে আসতেন। এঁদের রান্না শুকতো ও মোচার ঘণ্টর কি রকম তারিফ করতেন স্বামীজি তা পরের অধ্যায়েই স্পষ্ট হবে।
ভুবনেশ্বরী জননীর সঙ্গে তার নাতি-দিদিমার সম্পর্ক। ভুবনবিজয়ী নাতিকে তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “আর কেন, তোর তো সব হলো। এবার বিয়েটা বাকি আছে! বিয়েটা করে ফেল।” দিদিমার কথা শুনে স্বামীজি হাসির হররা তুললেন।