আচার্য শঙ্করের জীবন ও শিক্ষা সম্বন্ধে এই বাংলায় তেমন আগ্রহ ইদানীং দেখা যায় না। অতি অল্পবয়সে তিনি সংসারত্যাগী হয়েছিলেন, মৃত্যুও হয়েছিল নিতান্ত কম বয়সে, অনেকের মতে মাত্র ৩২ বছরে। তার জননীর নাম বিশিষ্টা।
শঙ্কর যখন সন্ন্যাসের জন্য মাতৃ-অনুমতি চাইলেন, তখন জননী বললেন, “বাবা তুমি চলে গেলে কে আমার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করবে? তুমি থাকতে আমার সৎকার কি জ্ঞাতিরা করবে?” জননীর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এসেছিল।
শঙ্কর : “আপনি প্রসন্নমনে আমার গৃহত্যাগের অনুমতি দিন…আপনার সৎকার আমি যেখানেই থাকি, যথাসময়ে এসে আমিই করব। সন্ন্যাসীর এই কাজ নিষিদ্ধ, তবু আপনার জন্য আমি এই কাজ করব।”
অনেকদিন পরের কথা, জগদগুরু শঙ্কর তখন শৃঙ্গেরীতে অধ্যাপনা করছেন, এমন সময় তিনি জিভে মাতৃস্তনদুগ্ধের আস্বাদ অনুভব করলেন। তিনি বুঝলেন, মায়ের অন্তিমসময় উপস্থিত। তিনি দ্রুত জন্মস্থান কালাডি গ্রামে ফিরে এলেন।
রোগশয্যায় শায়িতা জননী বিশিষ্টা তার পুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা এতে বিলম্ব কেন?”
আচার্য শঙ্কর নিঃশব্দে জননীসেবায় মনোনিবেশ করলেন। স্নেহময়ী জননী জানতে চাইলেন, “বৎস যে জন্য গৃহত্যাগী হয়েছ তাহা সিদ্ধ হয়েছে তো?”
শঙ্কর নীরবে মাতৃসেবায় ব্যস্ত রইলেন, পুত্রমুখ দর্শনে জননী সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে গেলেন।
জননীর দেহাবসানের পর স্বার্থপর আত্মীয়রা বেশ হাঙ্গামা বাধালেন। তারা শঙ্করকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেন শবপার্শ্বে বসে আছেন? সন্ন্যাসীর তো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অধিকার নেই।..বুঝেছি, সন্ন্যাসী হবার কষ্ট দেখে গৃহী হতে ইচ্ছা হয়েছে! মুখাগ্নি করে সম্পত্তির মালিক হবার ইচ্ছা রয়েছে। তুমি সন্ন্যাস নিয়ে বেদমার্গ থেকে বহির্ভূত হয়েছ, অন্যদেশে গিয়ে ম্লেচ্ছত্ব প্রাপ্ত হয়েছ, নষুদিরী ব্রাহ্মণ হয়ে কেরল ত্যাগ করে তুমি জাতিভ্রষ্ট হয়েছ–তোমাকে আমরা কিছুতেই মুখাগ্নি করতে দেব না।”
শঙ্কর : আপনারা তো আমার জননীর কোন যত্নই করেননি।.আমিই শেষকার্য সম্পন্ন করব।
চিতা সজ্জিত হল। কিন্তু অগ্নি কোথায়? কেউ অগ্নি দেবে না, তখন প্রয়াতা মায়ের দক্ষিণ হাতে অরণি কাঠ রেখে শঙ্কর অগ্নিমন্থন করলেন এবং সেই আগুনেই মাতৃদেহের সৎকার হলো।
শঙ্করের প্রতি নির্মম দুর্ব্যবহারের খবর পেয়ে স্থানীয় নরেশ রাজশেখর পরে শঙ্করদর্শনে এসেছিলেন এবং দুষ্ট আত্মীয়দের যথাবিহিত শাস্তিবিধান করেছিলেন। শঙ্করের জন্ম ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে এবং দেহাবসান বোধ হয় ৮১২ খ্রিষ্টাব্দে।
.
এক, এমনকি দুই কোকিলেও বসন্ত আসে না। মাতৃপ্রেমে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সন্ন্যাসী শঙ্করকে আমরা তো দেখলাম। আরও কে কে আছে তা একবার খোঁজ নিলে একালের বিবেকানন্দকে বোঝা বোধহয় সহজ হয়ে ওঠে।
বেশিদূর যাবার প্রয়োজন নেই, ঘরের কাছেই রয়েছেন শ্রীচৈতন্য। কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত চৈতন্যচরিতামৃত অবশ্যই সন্ধানী পাঠকের চোখ খুলে দেয়। মহাপ্রভুর জীবনের কয়েকটি মুহূর্ত পাঠককে একবার মনে করিয়ে দিতে চাই।
“নবদ্বীপে শচীমাতাকে দেখে প্রভু দণ্ডবৎ করলেন। পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে শচীদেবী কাঁদতে লাগলেন। দুজন দুজনকে দেখে আকুল হয়ে পড়লেন। পুত্রের মাথায় চুল নেই দেখে শচীমাতা মনে বড় ব্যথা পেলেন। শচীদেবী পুত্রের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন, তাকিয়ে থাকেন, চুম্বন করেন। চোখে জল এসে ঝাঁপসা করে দিচ্ছে, ভাল দেখতে পাচ্ছেন না, কেঁদে কেঁদে বললেন,বাছা নিমাই, বিশ্বরূপের মত নিষ্ঠুর হবে না। সেও সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেল। আমি একটু দেখতে পেলাম না। তুমি সেরকম কোরো না, তাহলে আমি আর বাঁচবো না।
“প্রভু কেঁদে কেঁদে বললেন–শোনো মা, এই শরীর তো তোমারই দেওয়া, আমার কিছুই নয়। তোমার থেকেই জন্ম, তুমিই লালনপালন করে এত বড় করেছ, কোটি জন্মেও তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না। যদিও সন্ন্যাস নিয়েছি, তা বলে তোমাকে কখনও ভুলতে পারব না।…প্রভু শচীমাতাকে সান্ত্বনা দিয়ে তার চরণবন্দনা করলেন। পরে তাকে প্রদক্ষিণ করে নীলাচলে যাত্রা করলেন।…
“পুরীতে শ্রীবাস পণ্ডিতকে আলিঙ্গন করে মহাপ্রভু বললেন, এই কাপড় এবং এই প্রসাদ মাকে দেবে, মায়ের সেবা ছেড়ে আমি যে সন্ন্যাস নিয়েছি এই অপরাধ ক্ষমা করার জন্য মাকে তুমি আমার হয়ে বলবে, মাকে সেবা করাই পুত্রের কাজ, আমি তা ছেড়ে পাগলের মত কাজ করেছি। মা পাগল ছেলের দোষ নেবে না, আমার কথা বলবে মাকে, মা খুশি হবে।… মায়ের আজ্ঞাতেই নীলাচলে রয়েছি, মধ্যে মধ্যে মায়ের চরণদর্শন করার জন্য যাব।”
আরও আছে। তার অত্যন্ত প্রিয় জগদানন্দকে চৈতন্যদেব প্রতি বছর। নবদ্বীপে পাঠাতেন, তিনি পুত্রবিচ্ছেদে দুঃখিতা জননী শচীদেবীকে প্রভুর সব সংবাদ জানিয়ে আশ্বস্ত করতেন। চৈতন্যচরিতামৃতের লেখকের প্রশ্ন : “মহাপ্রভুর মতন মাতৃভক্ত কতজন আছে?তিনি মাতৃভক্তের শিরোমণিতুল্য, সন্ন্যাস নিয়েও মাকে সেবা করে যাচ্ছেন।”
স্বামী বিবেকানন্দও বলতেন, “যে মাকে পুজো করেনি সে কখনও বড় হতে পারে না।”
ব্রহ্মবাদিন পত্রিকায় ভুবনেশ্বরী দেবীর মহাপ্রয়াণ বর্ষে (১৯১১)নামহীন এক লেখক অথবা লেখিকার তিনটি প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। সেখানে বিশ্ববিজয় করে কলকাতায় ফিরে এসে (১৮৯৭) স্বামীজির মাকে দেখতে যাওয়ার একটি দৃশ্য আছে। “পেট্রিয়ট, অরেটর, সেন্ট কোথায় হারিয়ে গেল! তিনি আবার যেন মায়ের কোলের খোকাটি। মায়ের কোলে মাথা রেখে, অসহায় দুষ্ট শিশুর মতন তিনি কাঁদতে লাগলেন, মা, মা, নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে আমাকে মানুষ করো।”