“পুনশ্চ :–এই চিঠি নিতান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয়।”
এই চিঠির প্রথম উত্তর আসে টেলিগ্রামে। ১লা ডিসেম্বর ১৮৯৮ বেলুড়ে বসে মহানুভব খেতড়িকে উত্তর দিতে বসেন রোগাক্রান্ত বিবেকানন্দ।
“আমি কি চাই তা বিশদভাবে লিখলাম। কলকাতায় একটা ছোট বাড়ি তৈরির খরচ দশহাজার টাকা। ঐ টাকায় চারপাঁচজনের বাসযোগ্য একটা ছোট বাড়ি কোনমতে কেনা বা তৈরি করা যায়। সংসার খরচের জন্য যে মাসিক একশ টাকা আপনি আমার মাকে পাঠিয়ে থাকেন তা তার পক্ষে যথেষ্ট। যদি আমার জীবদ্দশা পর্যন্ত আমার খরচ নির্বাহের জন্য আরও মাসিক একশ টাকা পাঠাতে পারেন তাহলে বড়ই খুশি হব। অসুস্থতার জন্য আমার খরচ ভয়ানক বেড়েছে; কিন্তু এই বাড়তি বোঝা আপনাকে খুব বেশিদিন বইতে হবে বলে মনে হয় না, কেননা আমি বড়জোর আর দু’এক বছর বাঁচবো। আমি আর একটি ভিক্ষা চাইব–মায়ের জন্য একশত টাকার সাহায্যটি সম্ভব হলে আপনি স্থায়ী রাখবেন। আমার মৃত্যুর পরেও যেন সে সাহায্য নিয়মিত পৌঁছয়। যদি কোন কারণে আমার প্রতি ভালবাসায় ও দাক্ষিণ্যে ছেদ টানতে হয়, এক তুচ্ছ সাধুর প্রতি একদা যে প্রেম-ভালবাসা ছিল তারই কথা স্মরণ করে মহারাজ যেন সাধুর দুঃখীমাতার প্রতি এই করুণা বর্ষণ করেন।”
যতদুর মনে হয়, বাড়ির জন্য ১০,০০০ টাকা দেওয়া খেতড়ির পক্ষে সম্ভব হয়নি। স্বামীজিও আলাদা বাড়ির পরিবর্তে ৬,০০০ টাকা দিয়ে খুড়ির কাছ থেকে পৈতৃক বাড়ির একটা অংশ কেনেন। শঙ্করীপ্রসাদ জানিয়েছেন মঠ-তহবিল থেকে এর জন্য স্বামীজিকে ৫,০০০ টাকা ধার করতে হয়।
*
এবার আমাদের নজর পরিব্রাজক বিবেকানন্দর ওপর–২০ জুন ১৮৯৯ কলকাতা থেকে জাহাজে চড়ে তিনি দ্বিতীয় ও শেষবারের মতো চলেছেন পশ্চিমে। তার যাত্রাসঙ্গী স্বামী তূরীয়ানন্দ ও মানসকন্যা নিবেদিতা। বিদেশে যাত্রার আগের দিন (১৯ জুন ১৮৯৯) গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী ও পূর্বাশ্রমের কয়েকজন আত্মীয়কে স্বামীজি বেলুড় মঠে আনিয়েছিলেন। একসময় সকলে স্বামীজির গান শোনার জন্য ঠাকুরঘরের বারান্দায় গিয়ে বসেন। মায়ের অনুরোধে তাঁর প্রিয়পুত্র শিব ও কালী বিষয়ক বেশ কয়েকটি গান গাইলেন। সন্ধ্যার সময় ঘোড়ার গাড়িতে মাকে সিমলায় পৌঁছে দিয়ে স্বামীজি বাগবাজারে বলরাম বসুর ভবনে চলে যান।
জাহাজ থেকে নিবেদিতা নিয়মিত চিঠি লিখতেন মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস বুলকে।
কলকাতা ছেড়ে জাহাজ যখন সিংহলদ্বীপের কূলে উপস্থিত হচ্ছে তখন নিবেদিতা চিঠি লিখছেন…। মঙ্গলবার সকাল, ২৮ জুন। “তিনি কীভাবে নিজের গর্ভধারিণীর কথা বললেন; মাকে কত কষ্ট দিয়েছেন তিনি, সেই সঙ্গে তাঁর প্রবল ইচ্ছা ফিরে এসে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি মায়ের কাছে নিবেদন করার।দেখছো না, এবার মধ্যে রয়েছে প্রকৃত বৈরাগ্য। সম্ভব হলে অতীতকে আমি খণ্ডন করতাম-দশ বছর কম বয়সী হলে আমি বিয়ে করতাম, কেবল আমার মাকে খুশি করবার জন্য, আর কোনো কারণে নয়। আহা! কীসের ঘোরে এই ক’বছর আচ্ছন্ন ছিলাম? উচ্চাশার পাগলামি–এরপর হঠাৎ যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বললেন–আমি কখনই উচ্চাভিলাষী ছিলাম না। খ্যাতির বোঝা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”
নিবেদিতা বললেন, “খ্যাতির ক্ষুদ্রতা আপনার মধ্যে কখনও ছিল না। তবে আমি ভীষণ খুশি যে আপনার বয়স দশ বছর কম নয়!”
মানসকন্যা নিবেদিতার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীজি খুব জোরে হাসতে লাগলেন।
.
১৬ আগস্ট ১৮৯৯ স্বামী বিবেকানন্দ লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক পৌঁছলেন। ডিসেম্বরে তিনি প্রবল উদ্দীপনায় লস এঞ্জেলিসে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন।
বড়দিনের দুদিন পরে আমরা দেখছি বিদেশের মাটিতেও মামলা মোকদ্দমার চিন্তা থেকে স্বামীজির মুক্তি মেলেনি। শ্রীমতী সারা বুলকে তিনি লিখছেন, “আমার শরীর এখন অনেক ভাল। আমি কাজ শুরু করেছি। মামলার খরচের জন্য ইতিমধ্যেই ১,৩০০ টাকা পাঠিয়েছি, যদি ওদের প্রয়োজন হয় তাহলে আরও পাঠাব।”
আরও খবর : “রাজযোগ-এর গ্রন্থস্বত্ব থেকে এবং খেতড়ির পাঠানো মোট ৫০০ পাউন্ড মিস্টার লেগেটের কাছে আছে, ওঁর কাছে আমার মোট গচ্ছিত একহাজার পাউন্ড। যদি আমি মরে যাই তাহলে দয়া করে ওই টাকা আমার মাকে পাঠিয়ে দিও।”
মায়ের জন্যে প্রবাসে রোগজর্জরিত সন্তানের চিন্তার শেষ নেই।কয়েকদিন পরেইনতুন বছরের নতুন মাসে (১৭ জানুয়ারি ১৯০০) লস এঞ্জেলিস থেকে মিসেসবুলকেবিবেকানন্দ জানাচ্ছেন: ”মিসম্যাকলাউডওমিসেস লেগেটের দাক্ষিণ্যে আমি সারদানন্দকে ২,০০০ টাকা পাঠাতে পেরেছি। ওঁরাই বেশি দিয়েছেন, বাকিটা আমার লেকচার থেকে।… আমি স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে এখানে এসেছিলাম। সেটা তো হয়েছেই, বাড়তি প্রাপ্তি মামলা-মোকদ্দমার জন্যে এই ২,০০০ টাকা।… এটা ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে, মঠের চিন্তা ঘাড় থেকে নামিয়ে, কিছুসময়ের জন্যে আমি মায়ের কাছে ফিরে যাই। আমার জন্যে তিনি বড্ড কষ্ট পেয়েছে। ওঁর শেষ দিনগুলো মসৃণ রাখতে হবে। আপনি কি জানেন, অমন যে অমন শঙ্করাচার্য তাকেও এই একই পথ বেছে নিতে হয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাকে মায়ের কাছে ফেরত যেতে হয়েছিল।… ১৮৮৪ সালে মাকে ছেড়ে আসা মস্ত ত্যাগের ব্যাপার ছিল, এখন তাঁর কাছে ফিরে যাওয়া আরও বড় ত্যাগের ব্যাপার। ‘মা’ বোধ হয় চাইছেন শঙ্করাচার্য যা করেছিলেন আমাকে দিয়েও তাই করাবেন।”