খেতড়ির কাছে লন্ডন থেকে লেখা চিঠিতে (১৩.১.১৮৯৯) এক সাহায্যপ্রার্থী বাঙালি (অক্ষয়কুমার ঘোষ) জানান, “আপনি মহিনের জন্য যে ত্রিশ পাউন্ড পাঠাইয়াছিলেন তাহা মিঃ স্টার্ডির কাছে রাখা আছে। গত উনিশ মাস মহিনের কোন খবর নাই।”
কলকাতা থেকে ৭ই জুলাই ১৮৯৮ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত খেতড়ির জগমোহনলালকে জানাচ্ছেন, “বহুদিন আপনার সহিত পত্রালাপ করি নাই। আমি সংবাদ পাইয়াছি আমাদের অগ্রজ এখন তুর্কীতে, তথা হইতে তিনি পারস্য, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া হইয়া চীনের প্রাচীর পর্যন্ত যাবেন। এই খবর তিনি মিঃ ট নামক এক আমেরিকানকে এবং তাহার মারফত আমরা পাই।”
সন্ন্যাসী হয়েও সংসারের নানাবিধ সমস্যা থেকে মুক্তি ছিল না বিবেকানন্দর। কিছুদিন পরে ফক্সকে স্বামীজি জানাচ্ছেন: “দয়া করে মহিনকে লিখবেন, সে যা করছে তাতে আমার আশীর্বাদ থাকবে। আমি অ্যাডভেঞ্চার ভালবাসি। একমাত্র কথা, আমার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে, বেশিদিন বাঁচবো বলে আশা করি না, মহিনকে যে করেই হোক মায়ের এবং পরিবারের হাল ধরতে হবে। আমার যে কোন সময়ে মৃত্যু হতে পারে। আমি এখন তাকে খুব পছন্দ করি।”
এই চিঠিতে লন্ডনপর্বের কিছু অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার ইঙ্গিত আছে, যদিও মহেন্দ্রনাথের সারাজীবনের সমস্ত রচনায় দাদার প্রতি গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রবাসে অপরের দয়ার ওপর নির্ভরশীল বিবেকানন্দ তার ভাইকে স্নেহপ্রশ্রয় দিয়েছিলেন তা, ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
পরবর্তী একসময়ে বিরক্তিতে ফেটে পড়ে বিবেকানন্দ ইংলন্ডের স্টার্ডিকে তীব্র পত্রাঘাত করেছিলেন। মিস মুলারের অভিযোগ ছিল, সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ পারিবারিক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েন। স্টার্ডিকে বিবেকানন্দ লেখেন : “সেন্ট জর্জেস রোডের বাড়ির দায়িত্বে ছিলে তুমি এবং মিস মুলার। আমার ভাই অসুস্থ মিস্ মুলার তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন।…তুমি আমাকে কাজের জন্যে যে পয়সা দিয়েছে তার প্রতিটি কড়ি ঠিক জায়গায় রয়েছে। তোমাদের চোখের সামনে আমি আমার ভাইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি–বোধহয় তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি, আমি তাকে একটা আধলা দিইনি যা আমার নিজের সম্পত্তি নয়।”
*
১৬ ডিসেম্বর ১৮৯৬ ইংলন্ড ত্যাগ করে ভারতের পথে যাত্রা শুরু করেন। বিবেকানন্দ। কলম্বো ঘুরে কলকাতায় ফেরেন ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭।
তারপর বেশ কিছুদিন ঝড়ের বেগে মঠ মিশন প্রতিষ্ঠা এবং আসমুদ্র ভারত ঘুরে বেড়ানো।
নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই স্বামীজির। পরের বছর সেপ্টেম্বরে তিনি কাশ্মীরে, ঠিকানা কেয়ার অব ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, প্রধান জজ। সেখানে দু’সপ্তাহ অসুস্থ হয়ে পড়ে থেকে আবার খেতড়ির মহারাজকে চিঠি (১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮): “আমার অর্থের প্রয়োজন। যদিও আমার আমেরিকান বন্ধুগণ আমায় যথাসাধ্য সাহায্য করছেন তবু সব সময় হাত পাততে লজ্জা হয়, বিশেষত এই কারণে যে রোগ হওয়া মানেই একটানা অর্থব্যয়। পৃথিবীতে একটিমাত্র লোকের কাছে ভিক্ষা চাইতে আমার লজ্জা বা সংকোচ হয় না, সে লোক আপনি! আপনি দেন বা না দেন, আমার কাছে দুই-ই সমান। যদি সম্ভব হয়, দয়া করে আমাকে কিছু টাকা পাঠাবেন।”
মহারাজ তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেন। কৃতজ্ঞ স্বামীজির উত্তর আসে বেলুড় থেকে। কলকাতার পোদ্দার শেঠ দুলিচাঁদ কাকরাণির কাছে ৫০০ টাকার যে অর্ডার কেটে পাঠিয়েছেন তার প্রাপ্তিস্বীকার এবং সেই সঙ্গে, “আমি এখন একটু ভাল আছি। জানিনা এই উন্নতি চলতে থাকবে কিনা।”
শরীর খারাপ থাকায় সংসার-সমস্যা মেটাবার জন্যে স্বামীজি ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। নভেম্বর মাসে তিনি খেতড়িকে লেখেন, “বংশলোপ নিবারণের জন্য কনিষ্ঠ ভ্রাতার বিবাহ দিতে চাই।”
এব্যাপারে মায়ের ইচ্ছা যে প্রবলভাবে উপস্থিত তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। স্বামীজি নিজে কিন্তু একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, যদি মহেন্দ্রনাথ বিয়ে করতে চান, তাঁকে দূর করে দেবেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সিদ্ধান্ত, মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথের মধ্যে ছোটকেই তিনি অধিক বিবাহযোগ্য মনে করেছিলেন। কিন্তু মনে রাখা ভাল, এই চিঠি লেখার সময় ভূপর্যটক মহেন্দ্রনাথের কোনো পাত্তা নেই।
পরের সপ্তাহে ২২ নভেম্বর ১৮৯৮ বেলুড় থেকে স্বামীজি খেতড়িকে সেই দুঃখময় গোপন চিঠি লেখেন যা পড়লে শতবর্ষ পরেও হৃদয়বান পাঠকের চোখ সজল হয়ে ওঠে। “মাননীয় মহারাজা,…আপনি জানেন বিদেশ থেকে ফেরার পর থেকেই আমি ভুগছি।… এই অসুস্থতা সারবার নয়।… এই দুবছর বিভিন্ন জায়গায় বায়ু পরিবর্তন করেও প্রতিদিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে, আমি এখন প্রায় মৃত্যুর দ্বারে। আজ আমি মহারাজের প্রদত্ত আশ্বাস, মহানুভবতা ও বন্ধুত্বের কাছে একটা আবেদন জানাচ্ছি। আমার বুকের মধ্যে একটা পাপ সারাক্ষণ পীড়া দেয়–আমার মায়ের প্রতি বড় অবিচার করেছি। আমার মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ বাইরে চলে যাওয়ায় মা শোকে একেবারে মুহ্যমান, এখন আমার শেষ ইচ্ছা, অন্তত কিছুকালের জন্য মায়ের সেবা করে পাপস্খলন করি। এখন আমি মায়ের কাছে থাকতে চাই, আমাদের বংশটি যাতে লোপ না পায় সেজন্য ছোটভাইয়ের বিয়ে দিতে চাই। এতে আমার ও আমার মায়ের শেষ কটা দিন যে শান্তিতে কাটবেতাতে সন্দেহ নেই। মা এখন এক জঘন্য বাসায় থাকেন। তার জন্যে ছোট একটা ভাল বাড়ি করে দিতে চাই। ছোটভাইটির উপার্জন ক্ষমতা সম্পর্কে আশা কম, তার জন্যেও কিছু করে যাওয়া দরকার। আপনি রামচন্দ্রের বংশোদ্ভব, যাকে ভালবাসেন, যাঁকে বন্ধু মনে করেন তার জন্য এই সাহায্য আপনার পক্ষে কি খুব কষ্টকর হবে? আমি জানিনা, আর কার কাছে এই আবেদন পেশ করতে পারি। ইউরোপ থেকে যে টাকা পেয়েছি তার সবই কাজ’ এর জন্যে–এবং তার শেষ পাইপয়সা পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হয়েছে।…”