মার্কিন দেশে প্রথম পর্বে মায়ের সঙ্গে স্বামীজির কী ধরনের ভাবের আদান-প্রদান ছিল তা আজও খুব স্পষ্ট নয়।
ইংলন্ডে ১৮৯৬ সালে আমরা আবার স্বামীজির অনেক পারিবারিক সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। পূর্বপর্বে আমরা জানি, তার প্রাণাধিক প্রিয় গুরুভাইরা স্বামীজির অনুরোধের ওপর গভীর গুরুত্ব দিয়ে তার পরিবারের সবরকম সমস্যা সামলাচ্ছেন। একমাত্র বিবেকানন্দর মতন মহামানবের পক্ষেই পূর্বাশ্রম ও সন্ন্যাসপর্বের দায়দায়িত্ব এমনভাবে পালন করা সম্ভব।
*
এবার কেন্দ্র লন্ডন। লন্ডন থেকে মিসেস ওলি বুলকে স্বামী বিবেকানন্দ ৫ জুন ১৮৯৬ জানাচ্ছেন, “আমার ভাই মহিন গত দু’মাস ধরে লন্ডনে রয়েছে, সে ব্যারিস্টার হতে চায়।”
মহেন্দ্রনাথের রচনা থেকে আমরা জানি, “শরত্মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) ১৮৯৬ সালের মার্চ মাসে কলকাতা থেকে জাহাজে লন্ডনে যান। শরৎ মহারাজ কলিকাতা পরিত্যাগ করিবার এক সপ্তাহ পরে বর্তমান লেখক আইন অধ্যয়ন করবার জন্য লন্ডনে গমন করেন।”
এই বিলেত যাওয়ার ব্যাপারে স্বামীজির সাহায্য বা সমর্থন কতখানি ছিল তা আজও অস্পষ্ট। যদিও মহিমবাবু লিখেছেন, “স্বামীজি বাচস্পত্য অভিধান চাহিয়া পাঠাইয়াছিলেন, সেইজন্য সকলে মিলিয়া ১০০ টাকা দিয়া অভিধানটি ক্রয় করিয়া বর্তমান লেখকের সহিত পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।”
লন্ডনে স্বামীজি তখন নিজের জীবনযুদ্ধ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। তার ওপর বিদেশে পদে পদে ভাইয়ের উপস্থিতি যে নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছিল তা এখন আমাদের জানা হয়ে গিয়েছে। আমাদের একমাত্র আনন্দ, মহেন্দ্রনাথ এইভাবে লন্ডনে হাজির হয়ে বিবেকানন্দর সমস্যা বাড়ালেও, তিনি না গেলে আমরা ‘লন্ডনে বিবেকানন্দ’ নামে তিন খণ্ডের অসামান্য গ্রন্থ থেকে বঞ্চিত হতাম।
আমরা জানি, বহুবৎসর পরে স্বামীজিকে দেখে মেজভাই মহিমের ভাইকে চিনতে একটু বিলম্ব হয়েছিল।
‘বিবেকানন্দ ইন দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থের নমস্যা লেখিকা মেরি লুইস বার্ক স্বামীজির কয়েকটি চিঠির সবকটি লাইন পুনরুদ্ধার করে প্রবাসী সন্ন্যাসীর তখনকার ছবিটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এর আগে আমেরিকা থেকে স্বামীজি একবার ইংলন্ডে গিয়েছিলেন। এটি দ্বিতীয়বার। স্বামীজি তাঁর ভাইকে দেখে আহ্লাদ করে একটি সোনার কলম দিয়েছিলেন। এই কলম মহেন্দ্রনাথ আবার ছোটভাইকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ডাকওয়ালাদের হাত থেকে তা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছয়নি। প্রথম সাক্ষাতের পর, পকেট থেকে পাঁচপাউন্ড দিয়ে ভক্ত কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে নিজের ভাইকে পাঠিয়ে দিলেন।
আরেকদিন দুপুরবেলায় ভাইয়ের ঘরে ঢুকে স্বামীজি পরামর্শ দিলেন, আঙুলগুলো সবসময় পরিচ্ছন্ন রাখবে, নখে যেন ময়লা না থাকে। বড় নখ হলে কেটে ফেলবে। আমার জামার পকেটে নখ কাটবার অনেকরকম যন্ত্র আছে। সর্বদা ফিটফাট থাকবে, নইলে লোকে ঘৃণা করবে।
মিসেস বুলকে স্বামীজি তার ভাই সম্বন্ধে লিখলেন, “আমি চাই সে ইলেকট্রিসিয়ান হোক। আমার ইচ্ছে সে আমেরিকায় গিয়ে কোনো ভাল ইলেকট্রিসিয়ানের অধীনে কাজ করে। খেতড়ির রাজা তাকে কিছু টাকা পাঠাবেন। আমার কাছে যে ৩০০ পাউন্ড আছে তার পুরোটাই আমি তাকে দিতে পারি। আপনি আমাকে বছরে যে ১০০ ডলার দিতে চেয়েছেন সেটা আমি নেব না।” এরপরেই ভাইয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন!”প্রত্যেক পনেরোদিন অন্তর তার জঙ্গল জ্বর’ হচ্ছে। ছেলেটি খুব ভাল।”
খ্যাতনামা শিল্পী নন্দলাল বসুর সঙ্গে পরবর্তীকালে মহিমবাবুর আন্তরিক যোগাযোগ হয়েছিল। তার স্মৃতিচারণ : “মহিমের বিলেত যাওয়ায় স্বামীজি খুশি হননি। সম্ভবত পয়সাকড়ির অভাবের জন্য। মহিমবাবু লন্ডনে বছর দেড়-দুই ছিলেন…খানিকটা অভিমান করে আর হাতে বেশি পয়সা না থাকার জন্যে মহিমবাবু বিলেত থেকে সোজা হেঁটে এদেশে ফিরে আসার মনস্থ করলেন।..সব রাস্তাটাই পায়ে হেঁটে হেঁটে…য়ুরোপের নানান দেশের ভেতর দিয়ে গিয়ে উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া, গ্রীস, ইরান, সিরিয়া, রাশিয়া, বুলগেরিয়া হয়ে…পাঁচ বছর ধরে দেশ পর্যটন করে ১৯০২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরলেন।” . মনে রাখা প্রয়োজন, বিলেতে যখন দুই ভাইয়ের দেখা হয় তখন স্বামীজির বয়স ৩৩, মহিমের ২৬, সারদানন্দের ৩০, দ্রুতলেখক গুডইনের ২৫ এবং অপর সঙ্গী জন ফক্সের ২৩। মহিম অকস্মাৎ উধাও হয়ে বিশ্বপরিভ্রমণে বেরুবার পরেও এই ফক্সের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। জেনে রাখা ভাল, উদাসী পথিক হয়ে বেরিয়ে পড়বার পরে প্রায় ছ’বছর মহিম তার মাকে একখানাও চিঠি লেখেননি।
পরের বছর মিস্ ম্যাকলাউডকে লেখা এক চিঠিতে বিবেকানন্দ অনুরাগী মিস্টার স্টার্ডি জানাচ্ছেন, “মহিমের ব্যাপার জানি না, সে একেবারে উধাও হয়েছে, কোনো ঠিকানা রেখে যায়নি। আমি তার চিঠিপত্তর পোস্টাপিসে ফেরত দিয়েছি।”
শোনা যায় লন্ডনে ভাইকে নিয়ে স্বামীজির বেশ কিছু অসুবিধা হয়েছিল। মহিম ইলেকট্রিসিয়ান হতে আগ্রহী নন। বিবেকানন্দর খুবই ক্ষোভ মিস মুলার তার ভাইকে জ্বর অবস্থায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ১৮৯৬ সালের শরৎকালে লন্ডনে মহিম একের পর এক লজিং হাউস পাল্টাচ্ছেন এবং তেমন কিছুই করছে না।
স্বামীজির ক্ষিপ্রলিপিকার জে জে গুডউইন সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মহেন্দ্রনাথ নিজেই পরবর্তীকালে জানিয়েছেন, সারদানন্দ ও গুডউইনের সঙ্গে ভাইকেও স্বামীজি একই সঙ্গে আমেরিকায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। “লন্ডন অপেক্ষা নিউ ইয়র্কে অনেক কিছু শিক্ষা করিবার বিষয় আছে।” আমেরিকাতে ইলেকট্রিসিটির কলকজা ও নানা প্রক্রিয়া লক্ষ্য করিয়া তিনি আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলেন।মহেন্দ্রনাথের ভাষায় “গুডউইনবর্তমান লেখককে আমেরিকাতে সাথী করিবার জন্য কয়েকদিন বিস্তর চেষ্টা করিয়াছিলেন। কখনও মিষ্টি কথায়, কখনও গালাগালি দিয়ে, কখনও বা হাস্যকৌতুকে নানাভাব উহার মত বদল করাইতে চেষ্টা করিলেন। স্বামীজির বাচনভঙ্গী অনুকরণ করে গুডউইন কথা বলেছিলেন।”গুডউইন তখন সিংহের সরব গর্জন করিয়া, ঘুসি পাকাইয়া বর্তমান লেখককে বলিতে লাগিলেন, মারব ঘুসি, দাঁত ভেঙে দেব, নাক ভেঙে দেব, চ আমেরিকায়।” অভিমানী মহিম দাদার কাছ থেকে কলকাতায় ফেরত আসবার জাহাজভাড়া না চেয়ে পরিব্রাজক হিসেবে বেরিয়ে পড়েন এবং বহু দেশ ঘুরতে ঘুরতে দেশে ফেরেন।