খেতড়ি রাজের ওপর স্বামীজির নির্ভরতার আরও কিছু কথা এখনও বাকি আছে। স্বামীজির জীবনসায়াহ্নের সেই মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলি গর্ভধারিণী প্রসঙ্গে যথা সময়ে এসে পড়বে।
কিন্তু তার আগে আমেরিকা ও ইউরোপে গিয়েও স্বামীজির মাতৃচিন্তার কিছু খবর নেওয়া মন্দ হবে না।
*
মার্কিনমুলুকের প্রথম পর্বে মাতৃপ্রেমী বিবেকানন্দ অবাক হলেন, ছেলেরা তাদের মাকে নাম ধরে ডাকছে। আরও অবাক হলেন যখন দেখলেন, মা সম্বোধন করলে মার্কিন মহিলারা আঁতকে ওঠেন। প্রথমে না বুঝতে পারলেও পরে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো, মা ডাকটা মেনে নেওয়া মানেই তো স্বীকার করে নেওয়া যে যথেষ্ট বয়স হয়েছে!
আমেরিকায় সুযোগ পেলেই পরিচিত মহলে তিনি গর্ভধারিণী মায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন। ছোটবেলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে মায়ের কাছে যেসব গল্প-কবিতা শুনেছেন তা হড়হড় করে বলে যেতেন। তাঁর স্মৃতিশক্তির উল্লেখ হলেই বলতেন, “হ্যাঁ, আমার মায়েরও ঐ ধরনের স্মৃতিশক্তি আছে। একবার রামায়ণ শুনলে তিনি গড়গড় করে বলে যেতে পারেন।”
স্বামীজির স্মরণে ছিল, তার মায়ের কণ্ঠস্বর খুব মিষ্টি। কৃষ্ণযাত্রার গান তিনি আপনমনে গাইতেন। দুপুরে কয়েক ঘণ্টা এবং রাত্রে কয়েক ঘণ্টা সেই বিদ্যুৎবিহীন যুগে নিত্যপাঠ করতেন।
আর জননীর শেষবয়সের দেহবর্ণনাও তত রয়েছে। তার শরীরের গঠন ছিল বলিষ্ঠ, চোখ দুটি বৃহৎ ও আয়ত–চলতিভাষায় পটলচেরা চোখ। তার মধ্যে সবল, দৃঢ়চিত্ত ও তেজস্বিতার ভাব যেন ঠিকরে বের হতো।” দেখে মনে হতো এমন মায়েরই স্বামীজির মত ছেলে হওয়া সম্ভব। তিনভায়েই কতকটা মায়ের মুখাকৃতি পেয়েছিলেন।
মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “স্বামীজির চোখদুটি মায়েরই অনুরূপ–তবে তার চোখে যে কি ছিল তা মুখে বলা যায় না।”
মায়ের ছিল আত্মশক্তি। চরম বিপদেও এই আত্মশক্তির আগুন তিনি নিভতে দেননি। এবিষয়ে বিবেকানন্দর উক্তি অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখা ভাল। “জগতের ইতিহাস হচ্ছে কতকগুলি আত্মশক্তিতে বিশ্বাসবান লোকের ইতিহাস।… যে মুহূর্তে একটা মানুষ বা একটা জাত নিজের উপর বিশ্বাস হারায় সেই মুহূর্তে সে মরে।”
ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের কারাবাসের সময় (স্বামীজির মৃত্যুর পরে) কলকাতার কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা স্যর নীলরতন সরকারের বাড়িতে বীরজননীকে ডেকে একটি মানপত্র দেন। স্থান ৬১ হ্যারিসন রোড, তারিখ ২৪ শ্রাবণ ১৩১৪।
মুক্তিলাভের পর ভূপেন্দ্র মাকে বলেছিলেন, “বিবেকানন্দর মা হয়ে তুমি কোন স্বীকৃতি পেলে না, কিন্তু আমার মা হয়ে তুমি জন-সম্বর্ধনা লাভ করেছ।”
ভূপেন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করছেন, হাসতে হাসতে বলেছিলাম। কারণ বিদেশে স্বামীজির মুখে মুখে মায়ের কথা প্রচারিত হয়েছিল। ১৮৯৪ খ্রষ্টাব্দে বোস্টনে স্বামীজি ‘মাই মাদার’ নামে এক উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা দেন। ডিভাইন মাদার। হিউম্যান মাদার কি করে আসছে, সেটি তিনি সেদিন বলছিলেন। বক্তৃতা শুনে বিদুষী শ্রোতৃবৃন্দ এতদূর মোহিত হয়েছিলেন যে বড়দিনের সময় তারা স্বামীজির অজ্ঞাতসারে মেরী-অঙ্ক সুশোভিত বালক খ্রীস্টের একটি সুন্দর চিত্রের সহিত একখানি পত্র দিয়া স্বামীজির জননীর নিকট প্রেরণ করেন। সেই পত্রে স্বামীজি ভগবান যীশুখ্রীস্টের সদৃশ এই ভাবটি প্রকাশিত হইয়াছিল।”
“আজ মেরীপুত্র ভগবান যীশুর জন্মদিন।…এই শুভক্ষণে আমরা আপনাকে অভিনন্দিত করিতেছি, কারণ আপনার পুত্র এক্ষণে আমাদিগের মধ্যে অবস্থান করিতেছেন। কয়েকদিন পূর্বে তিনি বলেন যে ওখানকার আবালবৃদ্ধবনিতার কল্যাণার্থ তিনি যাহা কিছু করিতে সমর্থ হইয়াছেন, তাহা কেবল আপনার শ্রীচরণাশীর্বাদে।…হে পুণ্যচরিতে, আপনার জীবনের কার্যসমূহ আপনার সন্তানের চরিত্রে প্রতিফলিত। সেই মহৎ কার্যের মাহাত্ম্য সম্যক উপলব্ধি করিয়া আমরা আপনার প্রতি আমাদের হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা নিবেদন করিতেছি।”
কিন্তু শুধু মাতৃস্তুতি নয়, মায়ের মতামতের ওপর স্বামীজির কতখানি নির্ভরতা ছিল তা স্পষ্ট হয় যখন প্রতাপ মজুমদার মার্কিন দেশে তার চারিত্রিক নিন্দে শুরু করেন–”ও কেউ নয়, ঠগ, জোচ্চোর, ও তোমাদের দেশে এসে বলে–আমি ফকীর।”
এই সময়ে স্বামীজির একটি করুণ চিঠি: “আমার বুড়ী-মা এখনও বেঁচে আছেন, সারাজীবন তিনি অসীম কষ্ট পেয়েছেন, সেসব সত্ত্বেও মানুষ আর ভগবানের সেবায় আমাকে উৎসর্গ করার বেদনা তিনি সহ্য করেছেন। কিন্তু তার সবচেয়ে ভালবাসা যে ছেলেটিকে তিনি দান করেছে, সে দূরদেশে গিয়ে কলকাতার মজুমদার যেমন রটাচ্ছে–জঘন্য নোংরা জীবনযাপন করছে, এ সংবাদ তাকে একেবারে শেষ করে দেবে।”
সৌভাগ্যের বিষয় একই সময়ে মার্কিনী মহিলারা আমেরিকা থেকে ভুবনেশ্বরী দেবীকে স্বামীজির অজান্তে জানান : “এখানকার আবাল-বৃদ্ধ বনিতার কল্যাণার্থে তিনি যাহা কিছু করিতে সমর্থ হইয়াছেন, তাহা কেবল আপনার শ্রীচরণাশীর্বাদে”।
আরও কয়েকবছর পরে বিদেশের মাটিতে স্বামীজি সমস্ত হৃদয় ঢেলে দিয়ে অপূর্ব ও স্বার্থশূন্য, সর্বংসহা, নিত্য ক্ষমাশীলা জননী’র প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।”ধন্য আমাদের জননী! যদি মায়ের পূর্বে আমাদের মৃত্যু হয়, তাহা হইলে মায়ের কোলেই মাথা রাখিয়া আমরা মরিতে চাই।..আমাকে পৃথিবীতে আনিবার জন্য তিনি তপস্বিনী হইয়াছিলেন। আমি জন্মাইব বলিয়া তিনি বৎসরের পর বৎসর তাহার শরীর-মন, আহার পরিচ্ছদ, চিন্তা কল্পনা পবিত্র রাখিয়াছিলেন। এই জন্যই তিনি পূজনীয়া।”