বেণীশঙ্কর শর্মার মতে, “স্বামীজিকে আমেরিকা পাঠাইবার যে ব্যয়বহুল সংকল্প মহারাজা গ্রহণ করেন, তাহার মধ্যে স্বামীজির মাতা ও ভ্রাতাদের জন্য মাসিক একশত টাকা ব্যয় বরাদ্দ অন্তর্ভুক্ত ছিল বলিয়া মনে হয়। মহারাজ মনে ভাবিয়া থাকিতে পারেন, স্বামীজিকে মাতা ও ভ্রাতা সম্পর্কিত দুশ্চিন্তা হইতে মুক্ত রাখিয়া বিদেশে পাঠানোই তাহার কর্তব্য।”
আমেরিকা যাত্রার দুদিন পর, ২ জুন ১৮৯৩, মহেন্দ্রনাথ মাতুলালয় থেকে লেখেন : “গত ৩১ মে তারিখে আপনার অনুগ্রহপত্র ও পঞ্চাশ টাকা পাইয়া কৃতার্থ হইয়াছি। আপনার পত্রের মর্ম স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীকে, আমার মাতা ও মাতামহীকে পাঠ করিয়া শুনাইয়াছি..আমার মাতা ও মাতামহী দাদার পৃথিবী পরিভ্রমণে সম্মতি জানাইতেছেন।…”
১৩ জুন ১৮৯৩ খেতড়িনরেশকে মহেন্দ্রনাথের আবার পত্রাঘাত। “অবগত হইলাম যে দাদা বর্মা গিয়াছেন। তথা হইতে চীন বা অন্যত্র কোথাও যাইবেন।…আমার মাতা ও মাতামহী আপনার ন্যায় মহানুভবের পরিবারবর্গকে আন্তরিক আশীর্বাদ জানাইতেছেন।”
একই দিনে খেতড়ির মহারাজাকে রামকৃষ্ণানন্দের চিঠি–”মহেন্দ্রনাথ আপনার প্রেরিত একশত টাকা পাইয়াছে।”
২০শে জুলাই ১৮৯৩ স্বামী শিবানন্দ এক চিঠিতে স্বামীজির পরিবারকে সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে মহারাজকে প্রশ্ন করেছেন, “কানাঘুষা শুনিতেছি, বিবেকানন্দ ইংলন্ড অভিমুখে যাত্রা করিয়াছে। যদি তাই হয়, আপনি কি তাহার ইংলন্ডের ঠিকানা জানেন?”
পারিবারিক সাহায্যের ব্যাপারটা এতই গোপন রাখা হয়েছিল যে প্রথম পর্বে মুন্সী জগমোহনলালও ব্যাপারটা জানতেন না। তখনকার দিনে রাজস্থান থেকে বাংলায় টাকা পাঠাবার পদ্ধতি সম্বন্ধে একটা মজার ধারণা পাওয়া যায় মহেন্দ্রনাথকে লেখা জগমোহনলালের ৬ জুলাই ১৮৯৩-এর চিঠি থেকে। “আমি মহামহিমান্বিত খেতড়ি মহারাজের অধীনস্থ কর্মচারি এবং আপনাদের পরিবারের যাবতীয় বিষয় তিনি বিশ্বাসযোগ্য বিবেচনায় আমাকে গোপনে জানাইয়াছেন..মহারাজের ইচ্ছানুযায়ী v/41 62743 নম্বর সম্বলিত একশত টাকার কারেন্সি নোটের অর্ধাংশ আপনাদের সংসার খরচের জন্য পাঠাইলাম। আপনার প্রাপ্তিপত্র পাইলে দ্বিতীয়াংশ পাঠাইব।”
৩১শে জুলাই ১৮৯৩ কলকাতা থেকে জগমোহনলালজীকে মহেন্দ্রনাথের উত্তর : “প্রীত হইলাম যে আপনি দাদাকে খেতড়ি হইতে মাদ্রাজ এবং তথা হইতে বোম্বাইয়ে স্টীমার পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়াছেন। কলিকাতায় তাঁহার সম্বন্ধে কোন সংবাদ পাওয়া যাইতেছেনা।…গত তিন মাস দাদা বাংলাদেশের কোন বন্ধুকেই কোন পত্ৰই দেন নাই।…আপনি আমার পাঠসংক্রান্ত খবর লইয়াছেন। আমি আপনাকে সানন্দে জানাইতেছি যে এযাবৎ আমি ভালভাবে লেখাপড়া করিয়াছি, ক্লাসের সহিত সমান তালে চলিতেছি এবং আমার অধ্যাপকগণ প্রীত আছেন।..”
“পুনশ্চ : একশত টাকার কারেন্সি নোটের অর্ধাংশ পাইয়াছি। ভবিষ্যতে এইরূপ কারেন্সি নোট পাঠাইলে দয়া করিয়া রেজেস্ট্রি যোগে পাঠাইবেন। কেননা পোস্টাপিসের লোকেরা সন্দেহক্ৰমে চোখ রাখিয়াছে এবং হয়তো খাম খুলিয়া নিজেরাই আত্মসাৎ করিবে, এইরূপ ইঙ্গিতও তাহারা দিয়াছে।”
স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ খেতড়িকে চিঠি লিখতেন বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের সরকারি অফিসের ঠিকানা থেকে। ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৮৯৪ তিনি খেতড়ির জগমোহনলালজীকে জানাচ্ছেন, “অনেকদিন পর আমাদের শ্রদ্ধেয় ভাই বিবেকানন্দর পত্র পাইয়াছি। তিনি এখন চিকাগোয় আছেন এবং ভাল আছেন।… কয়েকদিন পূর্বে মহেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিয়াছি। সে, তাহার মাতা, ছোট ভাই সকলে কুশলে আছে। সে এখন লেখাপড়া লইয়া বিশেষ ব্যস্ত, প্রতিদিন একটি করিয়া পাঠ্য পুনর্পাঠ করিতেছে। আগামী মাসের ২৬ তারিখে তাহার পরীক্ষা। স্বামীজির আত্মীয়বর্গের অভাব মোচনের ভার যখন মহারাজ লইয়াছেন তখন আমার আর উক্ত বিষয়ে কোনরূপ চিন্তা করা সাজে না; কি কর্তব্য তিনিই ভাল জানেন।”
সম্প্রতি বিভিন্ন পরীক্ষায় মহেন্দ্রনাথের ফলাফল ও সার্টিফিকেট দেখার সৌভাগ্য হয়। এনট্রান্সে (১৮৮৮-৮৯) প্রথম শ্রেণী পেলেও, এফ এ এবং বি এতে তিনি থার্ড ডিভিশন। বি এতে তৃতীয় শ্রেণী পেয়ে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যেতে সেযুগেও দুঃসাহসের প্রয়োজন হতো।
উনিশ শতকের শেষ দশকে মাসিক একশ টাকার নিয়মিত ব্যবস্থা নিতান্ত ছোট ব্যাপার নয়। তখন কলকাতায় শিক্ষিত কেরানির মাইনে তো ১৫ টাকা। যাঁরা মাসে পঞ্চাশ টাকা পান তারা দোলদুর্গোৎসব করতেন। কেউ কেউ বলেন, এই একশ টাকা আজকের দশহাজার টাকা, কেউ বলেন কুড়ি হাজার টাকা। গুরুর পরিবারের প্রতি একজন ভক্তের এই বদান্যতা সত্যিই স্মরণে রাখার মতন। কারণ বাঙালিরা পরবর্তীকালেও রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের ভক্ত হলেও কখনও তারা উদারহস্ত হননি। মনে রাখা প্রয়োজন, টাইটেল মহারাজা হলেও, খেতড়ি এমন কিছু বড় আকারের রাজ্য ছিল না। আরও মনে রাখা দরকার, মামলামোকদ্দমার রাহু সারাক্ষণ পিছনে লেগে থাকলে সেই সন্তাগণ্ডার যুগেও একশ টাকার মাসিক ব্যবস্থা কোনো সমস্যার অবসান ঘটায় না।
আরও একটি লক্ষ্য করবার বিষয় রয়েছে–দানের গোপনীয়তা। মহারাজ অজিত সিং চাননি তাঁর সাহায্যর কথা প্রকাশিত হোক। এই সাহায্যপর্বের শুরু ১৮৯১ সালে, কিন্তু খবরটা প্রকাশিত হল আরও আটদশক পরে যখন দত্ত পরিবারের নায়ক-নায়িকাদের কেউ ইহজগতে নেই। ভুবনেশ্বরীর জীবনাবসান ১৯১১, দিদি স্বর্ণবালার ১৯৩২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, মহেন্দ্রনাথের ১৪ অক্টোবর ১৯৫৬ এবং কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্রনাথের ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬১। যদিও স্বামীজি প্রকাশ্যে খেতড়ির ঋণ স্বীকার করে বিদেশ থেকে ফিরে (১৭ ডিসেম্বর ১৮৯৭) বলেছিলেন, “ভারতের উন্নতির জন্য সামান্য যা কিছু আমি করতে পেরেছি খেতড়ি রাজের সঙ্গে পরিচয় না হলে তা আমার পক্ষে সম্ভব হত না।”