এই পিপাসানিবৃত্তির প্রচেষ্টায় সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিবেকানন্দ সম্পর্কে কয়েকটা ছোট আকারের প্রবন্ধ লেখা হয়। সেই লেখাগুলি বেশ কয়েকজন পাঠকের নজরে আসে। প্রধানত তাদেরই প্ররোচনায় খোঁজ করতে হল কিছু পুরনো কাগজপত্রের। দেখলাম, দীর্ঘদিন ধরে আমার অজান্তেই কিছু কিছু উপাদান হাতের গোড়াতে সংগৃহীত হয়ে রয়েছে। অতএব সাহস করে আসরে নেমে পড়া গেল।
অচেনা অজানা বিবেকানন্দ সত্যিই বহুমুখীতার স্বল্পপরিসর বিচিত্র জীবনের কয়েকটা মাত্র দিক এবারের এই অনুসন্ধানের আওতায় আনা গেল।
যাঁদের জন্য এই লেখা, তারা চাইলে ভিক্ষালব্ধ সংগ্রহের ঝুলি থেকে আরও কিছু তথ্য আর একটি বইতে সাজিয়ে দেবার ইচ্ছা রইল।
শংকর
.
ত্রয়োদশ সংস্করণের নিবেদন
সুদূর সেন্ট লুইস, আমেরিকা থেকে সন্ন্যাসী, গবেষক ও লেখক স্বামী চেতনানন্দ সস্নেহে কিছু মন্তব্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আশীর্বাদে এই সংস্করণে নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু সংশোধন ও সম্পাদনা করা গেল! স্বামী চেতনানন্দকে জানাই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
ভূতপূর্ব পাঠক এবং বর্তমানে বন্ধু শ্ৰীঅরুণকুমার দে এবারও সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। তাঁকেও নমস্কার।
শংকর
.
প্রচ্ছদচিত্র
স্বামীজির এই অবিস্মরণীয় ছবিটি কে তুলেছিলেন এবং কোথায় তুলেছিলেন তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এতোদিন বলা হয়েছে, এইটাই বেলগাঁও ছবি, তোলা আমেরিকযাত্রার আগে অক্টোবর ১৮৯২। কেউ কেউ বলেন, ছবিটি হায়দ্রাবাদে তোলা ১৮৯৩ সালের। গোড়ার দিকে। আবার একদলের দাবি, ছবি নেওয়া হয় চেন্নাইতে। নতুন মত, ১৮৯১ এপ্রিলের গোড়ায় জয়পুরে তোলা।
স্বামীজির ভক্ত ও শিষ্য হরিপদ মিত্র বেলগাঁওতে যে ছবি তুলিয়েছিলেন তা রক্ষা পেয়েছে। হরিপদ মিত্র নিজেই জানিয়েছেন, স্বামীজি ছবি তোলাতে খুব অনিচ্ছুক ছিলেন। সেক্ষেত্রে, এই ছবিটি বেলগাঁওয়ে তোলার সম্ভাবনা খুব কম। বেলগাঁওয়ের ছবিটি সম্ভবত তুলেছিলেন এস মহাদেব অ্যান্ড সন স্টুডিওতে গোবিন্দ শ্রীনিবাস ওয়েলিং।
ওপরের ছবিটি সম্পর্কে স্বামীজির সহাস্য মন্তব্য : ঠিক যেন। ডাকাতদলের সর্দার!
এই সময়ে তার সম্বলের মধ্যে একখানি গেরুয়া বস্ত্র, দণ্ড,কমণ্ডলু ও কম্বলে জড়ানো দু’চারখানি বই। এছাড়া সঙ্গে আর কিছুই থাকতো না। তার কাছে কোন পয়সাও থাকতো না।
রাজপুতানা ভ্রমণকালে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “মহারাজ, আপনি কেন গেরুয়া পরেন?” স্বামীজির উত্তর, “কারণ এটাই ভিখিরির বেশ। শাদা কাপড়ে ঘুরলে লোকে আমার কাছে ভিক্ষে চাইবে। আমি নিজেই ভিখিরি, বেশীরভাগ সময়ে আমার নিজের কাছেই একটা পয়সা থাকে না। অথচ কেউ ভিক্ষে চাইলে না দিতে পারলে আমার বেজায় কষ্ট হয়। আমার এই গেরুয়া কাপড় দেখলে ওরা বুঝতে পারে আমিও ভিখিরি। কেউ ভিখিরির কাছে ভিক্ষে চায় না।”
.
০১. সন্ন্যাসী ও গর্ভধারিণী
“আমার ছেলে চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাসী হয়েছিল,” এই কথা তার জীবনসায়াহ্নে বেশ গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন এক গর্ভধারিণী। যাঁদের কাছে তিনি একথা বলেছিলেন তাঁরা তরুণ সংসারত্যাগী, কিংবদন্তি সন্ন্যাসীর জননীকে দেখতে তারা এসেছিলেন উত্তর কলকাতার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে বিবেকানন্দর জন্মভিটায়। তখন অবশ্য তিনি ইহলোকে নেই।
বৈরাগ্যের এই দেশে স্মরণাতীত কাল থেকে মুক্তিসন্ধানী মানুষ সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছেন, সংসারের মায়াবন্ধনকে তাঁরা ভাল চোখে দেখেননি, কিন্তু তবু প্রশ্ন জেগে থাকে, যার জঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া যায়, যার স্তন্যপানে অসহায় শিশু জীবনরক্ষা করে, তাকে কি কোনো অবস্থাতেই পরিপূর্ণ ত্যাগ করা সম্ভব? অভিজ্ঞরা জানেন, এইসব প্রশ্নকে চিরতরে ভস্মীভূত করার জন্যই সন্ন্যাসপথের পথিককে নিজের শ্রাদ্ধ নিজে করতে হয়। পূর্বাশ্রমের সঙ্গে সকল সম্পর্ক সন্দেহাতীতভাবে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করার জন্যই তো এই আত্মশ্রাদ্ধ।
কিন্তু সন্ন্যাসীও তো মানুষ। গর্ভধারিণী জননীর ঋণ এবং মোক্ষের আহ্বান যতই ভিন্নমুখী হোক, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবসন্তানরাও কোনো যুগে এই দ্বন্দ্বের সম্পূর্ণ অবসান ঘটাতে সফল হননি। একালের সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন, “সন্ন্যাস অর্থ, সংক্ষেপে মৃত্যুকে ভালবাসা। আত্মহত্যা নয়–মরণ অবশ্যম্ভাবী জেনে নিজেকে সর্বতোভাবে তিলে তিলে অপরের মঙ্গলের জন্য উৎসর্গ করা।” এরই পাশাপাশি উত্তর কলকাতায় তারই প্রতিবেশী মহাকবির ঘোষণা, বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়। অসংখ্য বন্ধন মাঝে মুক্তির স্বাদ গ্রহণের জন্য সত্যসন্ধানীর বার বার জীবনসমুদ্রে অবগাহন।
চব্বিশ বছর বয়সে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের যে প্রতিবেশী বৈরাগী হয়ে সব বন্ধন ছিন্ন করলেন, বিশ্ববাসীকে শোনালেন অনন্তকালের মুক্তিবাণী, তিনি বোধহয় উল্টোপথের যাত্রী। সমস্ত বন্ধন থেকে অনায়াসে মুক্ত হয়েও এবং অতীত বন্ধনকে অস্বীকার করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েও তা করতে রাজি হলেন না, যদিও সমকালের দৃষ্টিতে কারও কারও মনে হলো, তিনি ঘর ও ঘাটের বিচিত্র দোটানায় পড়ে থাকলেন।
আত্মশ্রাদ্ধের পর সর্ববন্ধন মুক্ত হয়েও যে মানবসন্তান অতীতবন্ধনকে অস্বীকার করে না, সে কি বিপথগামী? না নরোত্তম?