পরিব্রাজক জীবনে মায়ের চিন্তা থেকে কখনও মুক্ত হতে পারেননি স্বামীজি। “মাদ্রাজে যখন মন্মথবাবুর বাড়িতে ছিলুম, তখন একদিন স্বপ্ন দেখলুম, মা মারা গেছেন! মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। তখন মঠেও বড় একটা চিঠিপত্র লিখতুম না–তা বাড়িতে লেখা তো দূরের কথা। মন্মথবাবুকে স্বপ্নের কথা বলায় তিনি তখনই ঐ বিষয়ের সংবাদের জন্য কলকাতায় তার করলেন।…মাদ্রাজের বন্ধুগণ তখন আমার আমেরিকায় যাবার যোগাড় করে তাড়া লাগাচ্ছিল; কিন্তু মায়ের কুশল সংবাদটা না পেয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। আমার ভাব বুঝে মন্মথবাবু বললেন, শহরের কিছু দূরে একজন পিশাচসিদ্ধ লোক বসবাস করে, সে জীবের শুভাশুভ ভূত-ভবিষ্যৎ সব খবর দিতে পারে…’পিশাচসিদ্ধ’ মায়ের মঙ্গল সমাচার বললে। ধর্মপ্রচার করতে আমাকে যে বহুদূরে অতি শীঘ্র যেতে হবে তাও বলে দিলে!”
পরিব্রাজকপর্বে স্বামীজি একবার সকলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেছিলেন। মীরাট থেকে গুরুভাইদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পরে অনেকদিন তার খবর নেই।
শেষে একখানা চিঠি এল বরানগরে, কিন্তু নাম লেখা নেই। বরানগরের হাতকাটা হাবুর বাড়িতে একটা ওষুধ পাওয়া যেত–ওইটা পাঠাতে অনুরোধ করেছেন। ওই চিঠি মধ্যমভ্রাতা মহিমকে দেখানো হলো। তিনি বললেন, নাম না থাকলেও দাদার চিঠি সন্দেহ নেই।
কয়েক বছর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের কোনো খবরই ছিল না। কেবলমাত্র জয়পুর থেকে একখানা চিঠি এসেছিল–তাতেও নাম লেখা নেই। পরে খেতড়ির রাজা অজিত সিং চিঠি দিতে লাগলেন। চিঠি বন্ধের আগে যে কয়েকখানি চিঠি এসেছিল তাতে স্বামীজির মনের ভাব যে অতি বিষণ্ণ তার প্রকাশ ছিল।
মহিমবাবু উল্লিখিত স্বামীজির একটি চিঠি বড়ই হৃদয়গ্রাহী : “ভগবান তো পেলাম না, অনেক চেষ্টা করলাম, তাতেও কিছু বুঝতে পারলাম না, এতে বুকের ভালবাসাটা বেড়ে গেছে, সকলের উপর একটা ভালবাসা এসেছে।”
*
মায়ের প্রতি, সংসারের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে স্বামীজি তার কর্তব্য পালন কীভাবে করেছিলেন, অথবা আদৌ করতে সক্ষম হননি তা এখনও ইতিহাসের আড়ালে রয়ে গিয়েছে।
নতুন অধ্যায়ের শুরু হলো ১৮৯১ সালে। ওই বছর ৪ জুন বৃহস্পতিবার খেতড়ি নরেশ অজিত সিংজী ৬-৩০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠলেন, সন্ধ্যায় যোধপুরের মহারাজ প্রতাপ সিং-এর সঙ্গে আধঘণ্টা কাটালেন, তারপর এক সন্ন্যাসী এলেন তিনি বাংলা, ইংরিজি ও সংস্কৃত : ভাষায় পারঙ্গম।নানা বিষয়ে আলাপ করে রাত এগারোটায় স্বামীজি বিদায় নিলেন। সন্ন্যাসীকে আহারও দেওয়া হয়েছিল।…
এই হচ্ছে পরিচয়ের প্রথম পর্ব। বলাবাহুল্য স্বামীজি খেতড়ি মহারাজের হৃদয় জয় করলেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, মহারাজও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর হৃদয়স্পর্শ করলেন। স্বামীজি প্রথমবারে খেতড়িতে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ছিলেন–পরিব্রাজক জীবনের দীর্ঘতম অবস্থান–প্রায় পাঁচ মাস। মনে রাখা প্রয়োজন, স্বামী প্রভানন্দের হিসাব অনুযায়ী স্বামীজি তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেলুড় মঠে মাত্র ১৭৮ দিন অবস্থান করেছিলেন।
এরপরেও তিনি দুবার খেতড়িতে এসেছেন, একবার আমেরিকা যাবার আগে এবং আরেকবার পাশ্চাত্যদেশ থেকে ফিরে।
খেতড়িতে থাকার কোনো একসময়ে মহারাজ অজিত সিং শ্রদ্ধেয় স্বামীজির পারিবারিক দায়িত্বর কথা শুনে তাঁকে চিন্তামুক্ত করতে মনস্থ করেন।
মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন : “খেতড়ির মহারাজা, শরৎ মহারাজের, যোগেন মহারাজের, সান্ডেলমশায়ের মারফৎ স্বামীজির মাতাঠাকুরাণীকে মাসে একশত টাকা পাঠাইয়া দিতেন এবং বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছিলেন যে, এসকল কথা যেন অপরে না জানিতে পারে।”
খেতড়ির মহাফেজখানায় ইদানীং যেসব চিঠির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, অন্তত ১৮৯২ থেকে স্বামীজির পরিবারের সঙ্গে মহারাজের পত্রালাপ চলছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ তারিখে ৭ রামতনু বোস লেন থেকে মহেন্দ্রনাথের চিঠি : “বহুদিন পত্র না পাইয়া বিশেষ চিন্তিত আছি।… প্রায় পনেরো দিন পূর্বে দাদার খবর পাইয়াছি। তিনি এখন মাদ্রাজে।”
২২ মার্চ ১৮৯৩-এর চিঠিতে মহেন্দ্রনাথ খেতড়ি মহারাজকে তার সম্প্রতিপঠিত পুস্তকের তালিকা দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে কনিষ্ঠ ভ্রাতা সম্বন্ধে জানাচ্ছেন, “কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে শহরের অন্যতম বিদ্যালয় মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে পাঠাইয়াছি। সে ভালই লেখাপড়া করিতেছে।…দাদার খবর পাইলাম। তিনি এখন মাদ্রাজে এসিসট্যান্ট কট্রোলার অফ মাদরাজ শ্ৰীমন্মথনাথ ভট্টাচার্যের গৃহে আছে।”
যাঁদের ধারণা, স্বামীজির দ্বিতীয়বার খেতড়ি ভ্রমণের সময় (এপ্রিল ১৮৯৩) পারিবারিক সাহায্যের কথা হয়, তা ঠিক নাও হতে পারে। ২১শে এপ্রিল থেকে ১০ মে স্বামীজি তিন সপ্তাহকাল খেতড়িতে ছিলেন।
বিদেশযাত্রার ব্যাপারে খেতড়ির অসামান্য অবদানের কথা এখন আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আমরা কেবল সন্ধান করছি মায়ের দুঃখ অপনোদনে স্বামীজির প্রচেষ্টার বিবরণ।
বেণীশঙ্কর শর্মা এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “যাহা কিছু পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাহাই নিন্দনীয় বা বর্জনীয় এমন মনোভাব তাঁহার ছিল না। মাতৃভক্তিকে তিনি সন্ন্যাসের বেদীমূলে বলি দেন নাই। বরং দেখি, মাতার জন্য তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নেতৃত্ব, যশ, সব কিছুই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।”