মামলা-মোকদ্দমার প্রথম ধাক্কা সামলে দিয়েই নরেন বিরলদৃশ্য হয়েছিলেন এবং সন্ন্যাসী হয়ে ভারত পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বাড়ির সঙ্গে বিশেষ কোন সম্পর্ক রইলো না, যদিও কলকাতায় থাকলে মাঝে-মাঝে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ১৮৯৭ সালে ইউরোপ থেকে ফেরবার আগে পর্যন্ত বাড়িতে কেউ তাকে গেরুয়া বসনে দেখেন নি।”
*
সত্যিই দুর্ভাগা জননী। তিন পুত্রই ভুবনেশ্বরীকে আমৃত্যু অশেষ বেদনা দিয়েছেন।
বরানগর মঠে ১৮৮৭ সালের গ্রীষ্মের প্রারম্ভে জ্যেষ্ঠ পুত্র গুরুতর অসুস্থ বলে অসহায় বিধবা সেখানে ছুটেছিলেন দ্বিতীয় পুত্রকে নিয়ে, কিন্তু নরেনই তখন নিয়ম করে দিয়েছে মঠে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। মাকে আচমকা ঢুকতে দেখে তার কথা, “আমিই নিয়ম করলুম, আর আমার বেলায়ই নিয়ম রদ হল?”
পরিব্রাজক বিবেকানন্দের কোনো খবরাখবর প্রায়ই থাকত না। মাকে লেখা স্বামীজির কোন চিঠি কারও সংগ্রহে নেই।
১৮৯১ সালে বৈশাখ মাসে রবিবারের এক সকালে ভুবনেশ্বরীর কাছে চিঠি এলো যে কন্যা যোগীন্দ্ৰবালা সিমলা পাহাড়ে আত্মহত্যা করেছে। তখন তার বয়স পঁচিশ। শোকাৰ্তমনে ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ চললেন বরানগর মঠে খবর দিতে।
যোগেন মহারাজ, বাবুরাম মহারাজ ও গিরিশচন্দ্র ঘোষ সিদ্ধান্ত করলেন স্বামী সারদানন্দের কাছে টেলিগ্রাম করবেন তিনি যাতে নরেনকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারেন, কারণ ভুবনেশ্বরী তখন অত্যন্ত শোকার্ত। হাওড়া স্টেশনে গিয়ে শরৎ মহারাজের নামে টেলিগ্রাম করা হল।
রামতনু বসু লেনে ভুবনেশ্বরী তখন অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে কাঁদছেন। বাবুরাম মহারাজ নিজেও শোকার্ত হয়ে বসে রইলেন, আর যোগেন মহারাজ জননীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। রাত ৯টায় সময় সন্ন্যাসীরা বাগবাজারে ফিরে গেলেন। যোগীন্দ্রবালার আত্মহত্যা সংবাদ সারদানন্দ মারফত বিবেকানন্দর কাছে আলমোড়ায় পৌঁছেছিল, তিনি প্রবল দুঃখও পেয়েছিলেন।
কিন্তু সংসারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর সে কী বেদনাময় সংগ্রাম।
মহেন্দ্রনাথের বর্ণনায় : টেলিগ্রামের মর্মার্থ শুনে শুরু হলো বুকের মধ্যে দড়ি টানাটানি। শেষে সন্ন্যাসীর জয় হলো। সারদানন্দকে ক্রন্দনরত সন্ন্যাসী বললেন, “তোরাই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে, চিঠি দিয়ে এত গোলমাল বাধাস।.. আমাকে সব সময় তুই বিরক্ত করিস। আমি জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না, তুই কেবল সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবি।”
আত্মহত্যার বংশ? বলরামবাবুর বাড়িতে যোগেন মহারাজকে স্বামীজি একবার বলেছিলেন, “আমাদের এত বুদ্ধি মেধা কেন জানিস? আমরা যে সুইসাইডের বংশ। আমাদের বংশে অনেকগুলো আত্মহত্যা করেছে… আমাদের পাগলাটে ধাত, হিসেব-নিকেশের ধার ধারে না। যা করবার তা একটা করে দিলুম, লাগে তাক, না লাগে তুক।”
দত্তদের মেধা প্রসঙ্গে আরও একটি সরস ব্যাখ্যা আছে। মেজভাই মহেন্দ্রনাথকে নিরঞ্জন মহারাজ একবার বলেন, “নরেনের এতো বুদ্ধি কেন জানিস?নরেন খুব গুড়ুক যুঁকতে পারে। আরে গুড়ুক না টানলে কি বুদ্ধি বেরোয়…তামাক খেতে শেখ। নরেনের মতন মাথা খুলে যাবে।”
বোনের আত্মহননের শোক সামলে নিয়ে, আবার সব যোগাযোগ ছিন্ন করে অধিকতর দুর্গম গিরিগহ্বরে আশ্রয় নেবার জন্যে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ আচমকা পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন।
বরানগরে মাঝে মাঝে নরেন্দ্রনাথ ফিরতেন, কিন্তু বলে যেতেন, এই শেষ, আর ফিরছি না। ১৮৯১ থেকে তার একাকী ভ্রমণ। গুরুভ্রাতাদের সঙ্গেও তিনি সম্পর্ক ত্যাগ করেন।
কিন্তু বিবেকবান বিবেকানন্দ কি সত্যই গর্ভধারিণীকে নিষ্ঠুরভাবে মন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন? না পেরেছিলেন?
সব চেয়ে আশ্চর্য, বিবেকানন্দর সাড়ে পাঁচশোর বেশি চিঠি আমাদের সামনে রয়েছে, কিন্তু একখানা চিঠিও নেই মাকে লেখা। মাও কি কোনোদিন বিলুকে একখানা চিঠি লেখেননি? বিশ্বাস হয় না, ভাবতেও ইচ্ছা করে না। সেসব চিঠি যদি লেখা হয়ে থাকে এবং সেইসব চিঠি খুঁটিয়ে দেখার সৌভাগ্য হলে গর্ভধারিণী ও সন্ন্যাসী সম্বন্ধে গবেষকরা নিশ্চয় আরও অনেক কিছু জানতে পারতেন।
কিন্তু বিবেকানন্দর মানসিকতার নিদর্শন তার অন্য কয়েকটি চিঠিতে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। দেওয়ান হরিদাস দেশাইকে তিনি লিখেছিলেন, “আপনি আমার দুঃখিনী মা ও ছোটভাইদের দেখিতে গিয়াছিলেন জানিয়া সুখী হইয়াছি, কিন্তু আপনি আমার অন্তরের একমাত্র কোমলস্থানটি স্পর্শ করিয়াছেন। আপনার জানা উচিত যে আমি নিষ্ঠুর পশু নই। এই বিপুল সংসারে আমার ভালবাসার পাত্র যদি কেহ থাকেন তবে তিনি আমার মা।.. একদিকে ভারতবর্ষ… লক্ষ লক্ষ নরনারীর দুঃখ.. আর অন্যদিকে আমার যত নিকট আত্মীয়-স্বজন আছে তাহাদিগের দুঃখ দুর্দশার হেতু হওয়া–এই দুইয়ের মধ্যে প্রথমটিকেই আমি ব্রতরূপে গ্রহণ করিয়াছি, বাকি যাহা কিছু প্রভুই সম্পন্ন করিবেন।”
আরেক জায়গায় সন্ন্যাসীর স্বীকারোক্তি : “জননীর নিঃস্বার্থ স্নেহ ও পূতচরিত্র উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হওয়াতেই তিনি সন্ন্যাসজীবনের অধিকারী হইয়াছেন এবং তিনি জীবনে যা কিছু সকার্য করিয়াছেন, সমস্তই সেই জননীর কৃপাপ্রভাবে।”
আমরা আরও দেখেছি, ভুবনেশ্বরী শুধু ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক ইংরিজি শিক্ষা দেননি–কেবল লৌকিক শিক্ষা নয়, নৈতিক শিক্ষাও দিয়েছেন। গর্ভধারিণীর মতে, “সংসার সমুদ্রের নানা আবর্তে পড়ে নৈতিক জীবনকে অবহেলা করা অত্যন্ত দূষণীয়।”