আপিল মামলার রায়ও যথাসময়ে বেরিয়েছিল ১৮৮৭ সালে চীফ জাস্টিস, জাস্টিস আর্থার উইলসন এবং জাস্টিস রিচার্ড টটেনহ্যাম-এর আপীল কোর্ট ভুবনেশ্বরীর পক্ষে রায় দিলেন। খুড়ির শোচনীয় পরাজয় ১০ নভেম্বর ১৮৮৭।
কিন্তু মামলা কি আর অত সহজে শেষ হয়! আমরা দেখবো এর রেশ গড়ায় বিবেকানন্দর দেহাবসানের মুহূর্ত পর্যন্ত।
*
এর পরের রিপোর্ট স্পষ্টভাবে আঁকার জন্য শঙ্করীপ্রসাদ বসুর রচনা থেকে কিছু ভিক্ষা নেওয়া যাক। স্বামীজি ৬ হাজার টাকা দিয়ে নিজের খুড়ির কাছ থেকে পৈতৃক বাড়ির একটা অংশ কিনে নেন। মঠ-তহবিল থেকে এর জন্য তাকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করতে হয়।
কিন্তু স্বামীজি এই ব্যাপারে দারুণভাবে ঠকেন, জানাচ্ছেন শ্রদ্ধেয় গবেষক। ৬ই আগস্ট ১৮৯৯, মিসেস ওলি বুলকে স্বামীজি লেখেন, “দুশ্চিন্তা? সম্প্রতি তা যথেষ্ট। আমার খুড়িকে আপনি দেখেছেন তিনি আমাকে ঠকাবার জন্য তলেতলে চক্রান্ত করেন। তিনি ও তাঁর পক্ষের লাকজন আমাকে বলেন, ৬০০০ টাকায় বাড়ির অংশ বিক্রি করবেন–সেটা আমি সরল বিশ্বাসে ৬০০০ টাকা দিয়ে কিনি। তারপর তারা বাড়ির অধিকার দেবেন না–এই বিশ্বাসে যে আমি সন্ন্যাসী হয়ে, জোর করে বাড়ি দখল নেবার জন্য আদালতে যাব না।”
“এর ফলে মামলা হয়। এবং কয়েক বছর গড়ায়। মামলাতে যথেষ্ট খরচ হয়। স্বামীজির সে খরচের টাকাও মঠ তহবিল থেকে নিতে হয়। পূর্বোক্ত পাঁচ হাজার টাকা এবং এই মামলা খরচের টাকার দুশ্চিন্তা স্বামীজিকে একেবারে অস্থির করে ফেলেছিল। তাঁর ব্যক্তিগত টাকা বলতে সেইসব টাকা, যা তাঁর অনুরাগীরা তাঁর নিজস্ব খরচের জন্য দিতেন, কাজের জন্য নয়; এই সঙ্গে ছিল বই বা প্রবন্ধসূত্রে, কিছুটা লেকচার সূত্রে উপার্জিত অর্থ।” শঙ্করীপ্রসাদ সবাইকে নিশ্চিন্ত করেছেন, “স্বামীজি শেষ পর্যন্ত ধার নেওয়া সব টাকা শোধ করতে পেরেছিলেন।”
বিবেকানন্দ পরিবারের কেউ কেউ লেখার সময় স্মরণে রাখেননি যে বিদেশ থেকে ফেরবার পরে স্বামীজি তার মাকে পৈতৃকবাড়ির অংশ কিনে দিয়েছিলেন। শঙ্করীপ্রসাদ সঙ্গত কারণেই অস্বস্তি বোধ করেছেন। “আমার মনে হয়। স্বামীজি তারকনাথ দত্তর বিধবা বধূকে অর্থসাহায্য করেছিলেন। (যা ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন)–তার শর্ত ছিল, তিনি ভুবনেশ্বরীর প্রাপ্য যে অংশ অন্যায়ভাবে অধিকার করে আছেন, সেটি ফিরিয়ে দেবেন।” সেখানেও তাকে চক্রান্তের শিকার হতে হয়।
সন্ন্যাসীর সাধনা ও যন্ত্রণাকে এক্স-রে করতে গিয়ে মামলা-মোকদ্দমার সাতকাহন গাইতে হলো। কিন্তু এই যন্ত্রণা মানুষের চোখের সামনে থেকে লুকিয়ে রাখলে বিবেকানন্দের বিবেক পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হয় না।
এর আগে শঙ্করীপ্রসাদ যে সম্পত্তি কেনাবেচার কথা উল্লেখ করেছেন তার বিবরণ স্বামী গম্ভীরানন্দ বিরচিত যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থের ছোট্ট ফুটনোটে ধরা আছে। “অন্য সূত্রে জানা যায়, স্বামীজি ২/১২/১৮৯৮ তারিখে অমৃতলাল দত্ত প্রভৃতির নিকট হইতে ২ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের এক-চতুর্থাংশ এবং ২৯/১/১৮৯৯ তারিখে গৃহাদি সহ ৩নং-এর জমি বাড়ি বিশ্বেশ্বরী দেবীর নিকট ক্রয় করেন। ২৭/৫/১৮৯৯ তারিখে তিনি উভয় সম্পত্তি স্বীয় জননীকে দান করেন।”
মামলার ছায়া প্রলম্বিত হয়েছে। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে (মার্চ ১৯০২) বেনারস থেকে সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখছেন, “ইউরোপ থেকে সামান্য যে টাকা এনেছিলাম তা মায়ের দেনা শোধ এবং সংসার খরচে লেগে গেল। সামান্য যা রয়ে গিয়েছে তাতেও হাত দেবার উপায় নেই, ঝুলে-থাকা মামলার জন্য লাগবে।”
বিরোধের শেষ মীমাংসার একটা সুন্দর ছবি স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপিতে আছে।
স্বামীজি ২৮শে জুন শনিবার ১৯০২ (তাঁর তিরোধানের এক সপ্তাহ বাকি নেই) পারিবারিক মামলাস্থান কলকাতায় গিয়েছিলেন। কয়েকজনকে নিয়ে বোনের বাড়ি নিমন্ত্রণও খেয়েছিলেন। দেখা করতে শরিক হাবুল (দত্ত) এলো। স্বেচ্ছায় মিটিয়ে নেবার কথা বলল। যদি মীমাংসা হয় তা হলে স্বামীজি আরও হাজার টাকা দেবেন বললেন। তারা রাজি হলো। হাবুলের সঙ্গে স্বামী ব্রহ্মানন্দ পন্টুবাবুর (এটর্নি) অফিসে গেলেন। শর্তাদি জানিয়ে ওঁদের এটর্নি এন সি বসুর কাছে চিঠি পাঠানো হলো। তারা উত্তরে ওঁদের শর্ত স্বীকার করে চিঠি দিলেন।
এতো তীব্রগতিতে একদিনে এইভাবে আইনপাড়ার সাধারণত কাজ হয় না। স্পষ্টই মনে হয়, স্বামীজি আন্দাজ করেছিলেন, অপেক্ষা করবার মতন সময় তার হাতে আর নেই।
মৃত্যুর দুদিন আগে (২রা জুলাই) পন্টুকে শান্তিরামের কাছ থেকে নিয়ে চারশো টাকা দেওয়া হলো–হাবুল দত্ত ও তমু দত্তর দাবি অনুযায়ী। সবই পারিবারিক চুক্তি অনুযায়ী করা হয়।
শুধু অর্থ নিয়েই মাতাপুত্রের সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। আমরা শেষ দেখেছি কাশীপুর থেকে মায়ের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ গাড়িতে ফিরছেন, পাশে ছোটভাই এবং মা কাশীপুরে ঠাকুরের কাছে যা শুনেছেন তা বলছেন।
আরও একটি দৃশ্য আছে, ১৬ আগস্ট ১৮৮৬ ঠাকুরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরে কাশীপুর শ্মশান থেকে নরেন বাড়ি ফিরে এলেন এবং জামাকাপড় ধুতে দিলেন। কাপড়ের খুঁটে ঠাকুরের অস্থি বাঁধা ছিল। পরের দিন তিনি মাকে জিজ্ঞেস করলেন, চাঁদরে অস্থি পেয়েছেন কি না। মা বললেন, চাঁদরের কোণে কতকগুলো কয়লার ছাই দেখে ফেলে দিয়েছি। ছেলে বললেন, “হায়! হায়! ওগুলোই তো রামকৃষ্ণের অস্থি।”