শচীমণির মামলার সময় ভুবনেশ্বরী তার স্বামীর সঙ্গে আদালতে গিয়েছিলেন। ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার সময় তিনি নরেনকে সঙ্গে যেতে বলেছিলেন, সে রাজি হয়নি। ভুবনেশ্বরী আদালতকে বলেন, রামসুন্দরের দ্বিতীয় ছেলের বংশধর ভোলানাথ ও মাধবচন্দ্রের প্রত্যেকের অংশ ওঁদের বিধবা বামাসুন্দরী ও বিন্দুবাসিনীর কাছ থেকে প্রত্যেককে ৫০০ টাকার বিনিময়ে তিনি কিনে নেন। বিক্রি কোবলার তারিখ ১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৭।
বাঁটোয়ারা কমিশনার রবার্ট বেল চেম্বার্সের রিপোর্টের ভিত্তিতে বিচারপতি আর্থার উইলসন রায় দিলেন, যৌথসম্পত্তিতে শচীমণির অংশ চার আনা। এই মামলায় সমস্ত পরিবারদের অংশ এবং বাসগৃহের সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল। চিত্রগুপ্ত’ আমাদের জানিয়েছেন, দেওয়াল তুলে ভাগাভাগি না হলেও, বাঁটোয়ারার ব্যাপারে খরচ হয়েছিল ২৮৯২ টাকা, এবং নিজ নিজ অংশের আনুপাতিক হারে শরিকরা সেই অর্থ মিটিয়ে দেন। পরবর্তী মামলায় প্রমাণিত হয়, এই টাকা দেওয়ার কথা ওঠে বিশ্বনাথের মৃত্যুর পরে এবং ভুবনেশ্বরীর দেওয়ার একটা অংশ মিটিয়েছিলেন খুড়ো তারকনাথ।
তখনকার ভুবনেশ্বরী সংসারজ্বালায় বড়ই জর্জরিত। একই সময়ে চলেছে ঠাকুরের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের লীলাখেলা। বিরক্ত ভুবনেশ্বরী নাকি একদিন বলেছিলেন, “এসব কি হচ্ছে বিলু? সংসারটা কি করে চলবে সেদিকে হুঁশ নেই, দিনরাত টোটো করে ঘুরছিস।”
নরেন নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, “সংসার চালাবার আমি কে মা? যিনি চালাবার তিনি চালিয়ে দেবেন।”
ঠাকুরের পরম ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত ভুবনেশ্বরীর নিকট-আত্মীয়, শিশুকালে মাতৃহারা হওয়ায় তিনি ভুবনেশ্বরীর স্তন্যদুগ্ধে লালিত হয়েছিলেন। তাকে ভুবনেশ্বরী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বিলু কি আর সংসারে ফিরে আসবে না?” গুরুপ্রাণ রামচন্দ্র ভরসা দিয়েছিলেন, “আপনাকে ছেড়ে ও যাবে কোথায়?”
খুড়ির সুবৃহৎ মামলার খবর নরেন্দ্রনাথ পান বরানগর মঠে থাকার সময়, যদিও মামলা দায়ের হয়েছে ঠাকুরের মহাসমাধির একমাস আগে। খুড়ির আর্জিতে আছে, ভুবনেশ্বরী যে সম্পত্তি কিনেছিলেন তা তার স্বামীর অর্থে বেনামীতে নেওয়া। সেইসময় খুড়ির প্রধান পরামর্শদাতা তার এক জামাই।
এটর্নি নিমাই বসু ভুবনেশ্বরীর জবাব দাখিল করলেন যথাসময় আমার স্বামী তার পোষ্যদের যাবতীয় খরচ প্রবাস থেকে নিয়মিত পাঠাতেন। এই সম্পত্তি আমার স্ত্রীধন। এই মামলায় মায়ের দেওয়া বাংলা স্বাক্ষর নরেন্দ্রনাথ শনাক্ত করেন।
.
মামলার শুনানির দেরি হতে পারে জেনে নরেন্দ্রনাথ তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। শুনানি শুরু হবার আগেই তিনি ফিরে আসেন। এই মামলায় সাক্ষীসাবুদ অনেক। নরেন্দ্রনাথ নিজেই সাক্ষ্য দিলেন ৮ মার্চ ১৮৮৭।
স্বামী গম্ভীরানন্দের মতে এই মামলায় ব্যারিস্টার ডবলু সি বনার্জি ভুবনেশ্বরীকে সাহায্য করেন। ব্যারিস্টার পিউ সায়েব নরেন্দ্রনাথকে বেকায়দায় ফেলবার জন্য আদালতে নানাভাবে জেরা করেন।
তোমার বয়স কত?
–তেইশ-চব্বিশ হবে।
তোমার পেশা কী?
–আমি বেকার। বর্তমানে আমি কিছুই করছি না। প্রায় দু’বছর আগে ১৮৮৫ সালে মেট্রোপলিটান ইনটিটিউশনে হেডমাস্টার পদে নিযুক্ত হই। কিন্তু মাসতিনেক পরে আমি সে কাজ ছেড়ে দিই। তারপর ডঃ আঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে ও তার অধীনে একটি কলেজে আমি কিছুদিন অধ্যাপনা করি।
পৈত্রিক বাড়িতে তিনি বহুদিন বসবাস করেন না, একথা ঠিক কিনা জানতে চাইলেন পিউ সায়েব।
–বাবা মারা যাওয়ার পর আমি মায়ের কাছেই থাকতাম। সব সময় যে থাকতাম একথা বলতে পারি না। আমার কাকা তারকনাথের মৃত্যুর সময়ে আমি বাড়িতে ছিলাম।
মিস্টার পিউ–তুমি কি কারও চেলা হয়েছ?
–চেলা কাকে বলে তা আমি জানি, কিন্তু আপনার ইঙ্গিতটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমি কখনও কোনো ভিক্ষাজীবী সাধুর চেলাগিরি করিনি।
মিস্টার পিউ জানতে চাইলেন, ধর্মীয় ব্যাপারে কোনোরকম চাঁদা তোলায় যুক্ত ছিলে?
–নরেন উত্তর দিলেন, রামকৃষ্ণদেবের জন্য তিনি কোনো চাদা গ্রহণ করেননি।
মিস্টার পিউকে প্রত্যাঘাত করার জন্য নরেন জিজ্ঞেস করলেন, মহাশয় আপনি চেলা শব্দটির অর্থ জানেন কি? ব্যারিস্টার সায়েব এবার একটু বেকায়দায় পড়ে গেলেন।
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নরেন্দ্রনাথ জানালেন, কাকা তারকবাবুর সঙ্গে তাঁর দু’বার বচসা হয়। কথাকাটাকাটির পরে তারকবাবুর সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হয়নি। কাকার মৃত্যুর আগে তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। মাও ফিরে বাড়িতে এসেছিলেন। মায়ের ঘরটি অক্ষত ছিল। নরেন ও পরের ভাই অন্য একটি ঘরে ছিলেন। অপর একটি ঘর তারকনাথ ভেঙে দিয়েছিলেন।
স্বামী গম্ভীরানন্দর অনবদ্য জীবনকথায় আমরা জানতে পারি, ইংরেজ জজ বলেন, “যুবক তুমি একজন ভাল উকিল হইবে।” বিপক্ষের এটর্নিও তাঁর হাত ধরে বলেন, “আমি জজসায়েবের সঙ্গে সহমত।”
দীর্ঘ শুনানির পরে হাইকোর্টের বিচারপতি ম্যাকফারসনের রায় প্রকাশিত হলো : বিশ্বনাথ প্রবাস থেকে স্ত্রীকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। সুতরাং তারকনাথ বেনামীতে সম্পত্তি কিনেছিলেন তা প্রমাণ করবার পূর্ণ দায়িত্ব তার স্ত্রীর। জ্ঞানদাসুন্দরী তার স্বামীর কোন হিসেব খাতা আদালতে দাখিল করেননি। বিপদ সাধলো তারকনাথের একটি পুরনো চিঠি, যেখানে এক আত্মীয়কে তিনি লিখছেন, সম্পত্তির প্রকৃত ক্রেতা তিনি নন, ভুবনেশ্বরী। এছাড়া এই সম্পত্তি কলকাতা কালেকটরেটে নথিভুক্ত করার জন্য ভুবনেশ্বরী একবার দেবর তারকনাথকে ওকালতনামা দিয়েছিলেন এবং সে দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন।