অতিসুন্দর সংক্ষিপ্তসার, কিন্তু বিবেকানন্দের বিড়ম্বনা বুঝতে গেলে আর একটু খবর সংগ্রহের প্রয়োজন। প্রথমেই বলে রাখা যাক, আমরা একাধিক মামলায় দত্তপরিবারকে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখছি। সময় অনুযায়ী সাজালে ব্যাপারটা সহজ হয়। যার শুরু নরেন্দ্রনাথের চোদ্দবছর বয়স থেকে।
১লা সেপ্টেম্বর ১৮৭৭ : মাধব দত্তর স্ত্রী বিন্দুবাসিনীর ভাগ কিনলেন ভুবনেশ্বরী। এই সম্পত্তি স্বামীর টাকায় কিনলেন, না খুড়ো তারকনাথ বেনামে ভাইপোর স্ত্রীর নামে কিনলেন, এই নিয়ে আদালতে মহারণ হয়েছিল পরে।
১৮৮০: আর এক শরিক শচীমণি দাসী (গৌরমোহন দত্তের দৌহিত্রী) সম্পত্তি বিভাজনের মামলা আনলেন, যাতে বিবেকানন্দ জননীও ছিলেন প্রতিপক্ষ। এই মামলায় বিখ্যাত এটর্নি রবার্ট বেচেম্বার্স সম্পত্তি বিভাজনের কমিশনার নিযুক্ত হলেন। যথাসময়ে তিনি ভাগ ঠিক করে দেন, কিন্তু তাতে এই মামলার শেষ হয় না।
আগস্ট ১৮৮৫ : পিতা বিশ্বনাথের মৃত্যু ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪ সালে, তারপরেই উকিল তারকনাথ ভুবনেশ্বরীর নামে কেনা সম্পত্তি নিজের বলে দাবি করতে লাগলেন।
বড়দিন ১৮৮৫ : যৌথসম্পত্তির একটা অংশে শৌচাগার মেরামতের জন্য পুরনো দেওয়াল ভাঙা নিয়ে ভুবনেশ্বরী পরিবারের সঙ্গে তারকনাথ কথাকাটাকাটিতে পড়লেন। এই কথাকাটাকাটিতে মাতৃনির্দেশে নরেন্দ্রনাথকে অংশ নিতে হয়েছিল।
২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : তারকনাথ দেহ রক্ষা করলেন।
জুলাই ১৮৮৬ : তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী হাইকোর্টে মামলা করলেন ভুবনেশ্বরী দেবীর বিরুদ্ধে।
১১ই আগস্ট ১৮৮৬ : শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পাঁচদিন আগে ভুবনেশ্বরী দাসী স্বামীর সম্পত্তির জন্য হাইকোর্টে লেটার অফ অ্যাডমিনিসট্রেশনের আবেদন করলেন কারণ বিশ্বনাথের কোনো উইল ছিল না। তখনকার উচ্চ আদালত কীরকম দ্রুত কাজ করতে পারতেন তার প্রমাণ, পরের দিনই (১২ আগস্ট) ছাড়পত্র পাওয়া গেল। সমস্ত কাগজপত্রে মায়ের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের সই আছে।
১৬ আগস্ট ১৮৮৬ : শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধি।
১৮৮৭ গোড়ার দিক : খুড়ি জ্ঞানদাসুন্দরীর মামলা আদালতে শুরু হলো। তার পক্ষে বিখ্যাত ইংরেজ ব্যারিস্টার পিউ।
৮ মার্চ ১৮৮৭ : নরেন্দ্রনাথ তখন বরাহনগর মঠ নিবাসী। সাক্ষ্য দিতে এসে অপরপক্ষের ব্যারিস্টারের জেরার মুখে পড়লেন, বললেন আমি বেকার।
১৪ মার্চ ১৮৮৭ : হাইকোর্টের রায়–হেরে গেলেন খুড়ি, কিন্তু আবার হাইকোর্টে আপিল।
১০নভেম্বর ১৮৮৭ : তিন বিচারকের আপিল আদালতের রায়। খুড়ির আবার পরাজয়।
১৮৮৮ : শচীমণি দাসী ১৮৮০ সালে যে পার্টিশন চেয়েছিলেন এবং রবার্ট বেলচেম্বার্স যে বাঁটোয়ারা করেছিলেন সেই অনুযায়ী সম্পত্তি বিভাজন চাইলেন শ্রীমতী ভুবনেশ্বরী।
২৩ নভেম্বর ১৮৮৮ : ভুবনেশ্বরী তার আইনগত অধিকার পেলেন।
২৮ জুন ১৯০২: প্রায় চোদ্দ বছর অতিক্রান্ত। তবু মামলার শেষ নেই।
৪ঠা জুলাই স্বামীজির দেহত্যাগ। তার কয়েকদিন আগে তার জীবনের শেষ শনিবারে (২৮ জুন) কলকাতায় এসে অনেক চেষ্টা করে স্বামীজি মামলার অবসান ঘটালেন, শান্তি ফেরাবার জন্য শরিকদের বেশ কিছু টাকা দিতে হল।
৪ জুলাই ১৮৮৯ বাগবাজার থেকে স্বামীজি বারাণসীতে প্রমাদাস মিত্রকে যে চিঠি লেখেন তাতে মামলার কিছু আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। “আমার মাতা ও দুই ভ্রাতা কলিকাতায় থাকে। আমি জ্যেষ্ঠ, মধ্যমটি এইবার ফার্স্ট আর্টস পড়িতেছে, আর একটি ছোট। ইহাদের অবস্থা পূর্বে অনেক ভাল ছিল, কিন্তু আমার পিতার মৃত্যু পর্যন্ত বড়ই দুঃস্থ, এমনকি কখন কখন উপবাসে দিন যায়। তাহার উপর জ্ঞাতিরা দুর্বল দেখিয়া পৈতৃক বাসভূমি হইতে তাড়াইয়া দিয়াছিল; হাইকোর্টে মকদ্দমা করিয়া যদিও সেই পৈতৃক বাটীর অংশ পাইয়াছেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হইয়াছেন–যে প্রকার মকদ্দমার দস্তুর।…এবার তাহাদের মকদ্দমা শেষ হইয়াছে। কিছুদিন কলকাতায় থাকিয়া, তাহাদের সমস্ত মিটাইয়া এদেশ হইতে চিরদিনের মত বিদায় হইতে পারি, আপনি আশীর্বাদ করুন।”
দশদিন পরে প্রমদাবাবুকে স্বামীজির আর একটি চিঠি। “…আমার এস্থানের গোযোগ প্রায় সমস্ত মিটিয়াছে, কেবল একটি জমি বিক্রয় করিবার জন্য দালাল লাগাইয়াছি, অতি শীঘ্রই বিক্রয় হইবার আশা আছে। তাহা হইলেই নিশ্চিন্ত হইয়া একেবারে কাশীধামে মহাশয়ের সন্নিকট যাইতেছি।”
জটিল পারিবারিক মামলা সম্পর্কে কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথের বক্তব্য: “স্বামীজীর জীবন বলে যেসব পুস্তক বাজারে চলছে তাতে একটা মিথ্যা সংবাদ আছে। এই মোকদ্দমায় ব্যারিস্টার ও উকিল পাই-পয়সাটি পর্যন্ত আদায় করেছিল, ব্যারিস্টারদের নগদ বিদায় দিতে হয়, আর উকিলের পাওনা, তা শেষ দেবার সময় লেখক হাজির ছিলেন এবং তার রসিদ আছে।”
*
মায়ের প্রতি দায়িত্বপালন করতে গিয়ে নিঃসম্বল সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে কি কঠিন সমস্যামালার মধ্যে পড়তে হয়েছিল এবং আমৃত্যু তিনি কীভাবে একের পর এক সেইসব আর্থিক বাধার মোকাবিলা করেছেন, এমনকি অপরের কাছে তার চিরউন্নত শির নত করতে বাধ্য হয়েছিলেন তার ইতিহাস অপ্রকাশিত না হলেও তেমন প্রচারিত নয়।
এই অংশটুকু না জানলে বোঝা শক্ত কত বড় হৃদয় ছিল তার, দায়িত্বকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ গ্রহণ করতে সারাজীবন ধরে তার কেন আপত্তি। মোক্ষসন্ধানী বিবেকানন্দই আমাদের মতন সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে গিয়েছেন ভবিতব্যের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ না করেও কী করে মানবত্বের হিমালয়শিখরে আরোহণ করা যায়। দরিদ্র বিশ্ববাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, দরিদ্র বাঙালির পূজ্য দেবতা হবার জন্য যা যা অবশ্য প্রয়োজন তার সব কিছুই আমরা স্বামীজির অবিশ্বাস্য জীবনসংগ্রাম থেকে খুঁজে পেতে পারি।