এই বিড়ম্বনার হিসেবখাতা দেখলে বোঝা যায়, বিবেকানন্দ একই সঙ্গে দেবী দুর্গার মতন দশ হাতে যুদ্ধ করছেন। রণক্ষেত্রে দেবী চণ্ডীকার যত অসুবিধাই থাক তার স্বাস্থ্যের কোনো সমস্যা ছিল না, বিবেকানন্দ সেই সৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। এক একবার মনে হয় আমাদের এই দুর্ভাগা দেশে জন্মগ্রহণ করে বড় কোনো স্বপ্ন দেখলে তার জন্যে মানুষকে অনেক বাড়তি মাশুল দিতে হয়। সংগ্রামী বিবেকানন্দকে ভালভাবে জানলেই এখন যাঁরা দারিদ্রের বিরুদ্ধে পারিবারিক সংগ্রাম করছেন এবং অনাগতকালে যাঁরা সংগ্রাম করবেন তাদের একাকিত্বের কিছুটা অবসান ঘটবে, তাদের মনে বিশেষ কোনো দুঃখ থাকবে না।
*
একজন প্রবীণ আইনজ্ঞ (চিত্রগুপ্ত) ছদ্মনামের আড়ালে থেকে কিছুদিন আগে দত্তপরিবারের কিছু আইনি তথ্য আমাদের উপহার দিয়েছেন, যার থেকে আমরা জানতে পারি ভিটেমাটি নিয়ে কবে কোন মামলা হয়েছিল এবং কোন আদালতে নরেন্দ্রনাথ কী সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।
মামলার সময় ভুবনেশ্বরী পালকি করে কলকাতার হাইকোর্ট পাড়ায় আসতেন। বিলু যেতেন পায়ে হেঁটে, কিন্তু তিনি মায়ের আগেই পৌঁছে যেতেন। মামলার কাগজপত্র থেকে আমাদের সব চেয়ে মূল্যবান প্রাপ্তি ভুবনেশ্বরী দেবীর বাংলা স্বাক্ষর–এমন সুন্দর হস্তলিপি কদাচ দেখা যায়।
বিবেকানন্দের পিতা বিশ্বনাথের ওকালতি তথ্য সম্বন্ধে একসময় হাইকোর্টে খোঁজখবর করেন ব্যারিস্টার সুধীরচন্দ্র মিত্র। তার অনুরোধে কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন চিফ জাস্টিস ফণিভূষণ চক্রবর্তী ১৯৫২ সালে সুধীরচন্দ্রকে কিছু বিবরণ পাঠিয়ে দেন।
ভিটেবাড়ি নিয়ে বিড়ম্বনা যখন সারাজীবনই ঘটেছে, তখন জেনে রাখা ভাল যে আমরা একনজরে একটা নয়, একগুচ্ছ মামলার উপস্থিতি লক্ষ্য করছি। এই মামলার বিবরণ মাথায় নিতে হলে যেসব বংশলিপি সেই সময় আদালতে পেশ করা হয়েছিল তাও পড়ে নেওয়া দরকার–কোন্ প্রজন্মে কার কতখানি অংশ, কোন শরিক বিবাহ করেননি, কে নিঃসন্তান, কে অপুত্রক, বা কে ছয় বা সাত কন্যার জনক তা জানা প্রয়োজন।
সিমলাপর্বের শুরুতে রামসুন্দর দত্ত, যাঁর পাঁচটি সন্তানের নাম আমাদের জানা।
জ্যেষ্ঠপুত্র রামমোহনের দুইপুত্র ও সাত কন্যা। এঁরই জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্গাপ্রসাদ সন্ন্যাসী হয়েছিলেন এবং তিনিই বিবেকানন্দর পিতামহ। রামমোহনের দ্বিতীয় পুত্রের পুত্র তারকনাথ ছিলেন বিবেকানন্দর খুড়ো, তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদাসুন্দরীর সঙ্গেই আদালতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ যা সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর জীবনকে মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
বলে রাখা ভাল এই খুড়ির ছয় কন্যা এবং পরবর্তীকালে যথাসর্বস্ব হারিয়ে তিনি ভুবনেশ্বরী-পুত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেন!
ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মোকদ্দমা বিশ্বনাথ দত্তের স্ত্রী বনাম তারকনাথ দত্তের স্ত্রীর মোকদ্দমা, তখন স্বামী বিবেকানন্দ বলে কেহ ছিলেন না।” মোকদ্দমার দায়ে খুড়ি জ্ঞানদাসুন্দরীর বাস্তুভিটা নিলাম হয়। “পরে স্বামীজির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে, তিনি একটা মোটা অঙ্কের টাকা এককালীন দান করেন।”
আমরা দেখবো, উদার হস্তে দান করেও সমস্যা মেটেনি, বরং স্বামীজি কিছুটা ঠকেছিলেন। ফলে মামলা আরও শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে, যদিও শেষ বয়সে এই খুড়ি নাকি দুঃখ করতেন, কয়েকজনের প্ররোচনায় তিনি এই মামলা করেন। বাড়ির সরকারও সুযোগ বুঝে হাজার পাঁচেক টাকা বাড়তি উপার্জন করেন। কিন্তু আমরা জানি, যৌথপরিবারে খুড়োখুড়ির অত্যাচার ছিল তুঙ্গে এবং এমন সময় গেছে যখন ভুবনেশ্বরীকে ‘একটি শাড়ি পরে কাটাতে হয়েছে।‘ বিশ্বনাথ দত্ত নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেটভরে খেতে পায় না।”
আজকের প্রজন্মের অনেকের কাছে যৌথপরিবারের লাইফস্টাইলটা অবোধ্য এবং রহস্যময় মনে হওয়া আশ্চর্য নয়। আমি রোজগার করছি, আর আমার বউ এক কাপড়ে প্রায় না খেয়ে কী করে থাকবে? বাড়ি যখন আমার তখন আদালতে ছোটাছুটি কেন?
উনিশ ও বিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের এ এক দুঃখময় দিক। ব্যাপারটা এই রকম : সম্পন্নলোকরা সেকালে যৌথ পরিবারে থাকতেন। রোজগারের পরিমাণ যার যতই হোক, হেঁসেল অথবা হাঁড়ি এক। দুই, আইনের চোখে সভ্যদের মালিকানার অংশ থাকলেও সম্পত্তিটা অবিভক্ত। একসময় এই অবিভক্ত সম্পত্তি ভাগ করে দেবার জন্যে পার্টিশন স্যুট চলতো চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে কলকাতার ধনপতি আইনজ্ঞদের বিশাল উপার্জনের একটা বড় অংশ আসতো এই ধরনের মামলা থেকে। এক প্রস্থে এইসব মামলার শেষ হতো না। একবার হারলে উচ্চ আদালতে আপিল হতো। বলে রাখা ভাল, দুর্বল নিঃসন্তান বিধবারা অনেক সময় টাকার প্রয়োজন হলে অবিভক্ত ভিটের নিজের অংশ আর একজন শরিককে বেচে দিতেন।
ভুবনেশ্বরী মামলার একটি সংক্ষিপ্তসার ভূপেন্দ্রনাথ দিয়েছেন, সেটি প্রথমে দিই। তারপর একটু-আধটু বাড়তি আলোকপাত করা যাবে। “আমরা যখন কালিপ্রসাদের বংশের সঙ্গে এজমালিতে থাকতাম সেসময়ে আমার মাতাঠাকুরানী দত্তদের অবিভক্ত পৈতৃক বাড়ির একাংশ, যা এক বালবিধবার বখরায় পড়ে, ক্রয় করেছিলেন। কিন্তু আমাদের খুল্লতাতের মৃত্যুর পর খুড়ি তা দখল করে আমাদের ভিটাচ্যুত করেন। তারপরে আদালতে মকদ্দমা রুজু করেন।”