মাস্টারমশায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মা কিছু বললেন?” নরেন্দ্র উত্তর দিলেন, “না তিনি খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত। হরিণের মাংস ছিল, খেলুম, কিন্তু খেতে ইচ্ছে ছিল না!”… “দিদিমার বাড়িতে সেই পড়বার ঘরে পড়তে গেলাম। পড়তে গিয়ে পড়াতে একটা ভয়ানক, আতঙ্ক এল–পড়াটা যেন কী ভয়ের জিনিস! বুক আটু বাটু করতে লাগল। অমন কান্না যা কখনো কাঁদি নাই। তারপর বই-টই ফেলে দিয়ে দৌড়। রাস্তা দিয়ে ছুট। জুতো-টুতো রাস্তায় কোথায় একদিকে পড়ে রইল।..আমি দৌড়াচ্ছি কাশীপুরের রাস্তায়! ‘বিবেক-চূড়ামণি’ শুনে আরও মন খারাপ হয়েছে। শঙ্করাচার্য বলেন, এই তিনটি জিনিস অনেক তপস্যায়, অনেক ভাগ্যে মেলে–”মনুষ্যত্বং, মুমুক্ষ্যত্বং, মহাপুরুষসংশয়ঃ।‘ ভাবলাম, আমার তিনটিই হয়েছে অনেক তপস্যার ফলে মানুষজন্ম হয়েছে, অনেক তপস্যার ফলে মুক্তির ইচ্ছা হয়েছে, আর অনেক তপস্যার ফলে এরূপ মহাপুরুষের সঙ্গলাভ হয়েছে।”
বরানগর পর্বে ঠাকুরের ত্যাগী-সন্তানদের কঠিন সাধনার কথা আমরা জানি। নরেন্দ্রর পক্ষে তখন উভয় সমস্যা। পারিবারিক মোকদ্দমা চালাতে হবে, আবার ঘোর বৈরাগ্যসাধন করতে হবে।” তেজস্বী বীরপুরুষ না হলে দুটি বিপরীতভাব একত্র রাখিয়া নিজেকে নিরাপদ রাখিতে পারে না। মোকদ্দমা চালাইবার টাকার এতো অনটন যে শশী (রামকৃষ্ণানন্দ) ও শরৎ (সারদানন্দ) নরেন্দ্রকে বলিলেন, “দেখ ভাই নরেন, তোমার টাকার অনটন। মকদ্দমার খরচ বেশি, আমরা বেশ দু’জনে গিয়ে বালির ইস্কুলে মাস্টারি করি না? কিছু কিছু রোজগার করি আর মঠে আসিয়া থাকি, তাহা হইলে সেই টাকা হইতে তোমার কিছু উপকার হইতে পারে।”
যাঁরা গুরুভাইয়ের পরিবারের দুঃখমোচনের জন্য এতো ভাবতে পারেন বরানগরে তাঁদের নিজেদের আর্থিক অবস্থা কত শোচনীয় ছিল তা শুনুন। রাত্রে শোবার কোনো বিছানা ছিল না। খান দুই তিন মোটা হোগলার চাটাই ঘরে পাতা ছিল, আর একখানা ছেঁড়া সতরঞ্চি ছিল। সকলে হাত মাথায় দিয়া রাত্রে নিদ্রা যাইত, বালিশের অভাব হইলে চাটাইয়ের নিচে একখানা ইট দিত তাহা হইতেই বালিশের অভাব পূরণ হইত..গেরুয়া কাপড় পরার প্রথা ছিল না…জুতাও ছিল না, জামাও ছিল না।”
কিন্তু তীব্র অভাবের মধ্যেও ভালবাসার তীব্র প্রকাশ। বরানগরপর্বে নরেনের মোকদ্দমা চলাকালীন সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন কেদারনাথ দাস। বাগবাজারের খড়ের ব্যবসা করতেন বলে এঁর নাম হয়েছিল খড়ো কেদার। তিনি স্বেচ্ছায় নরেনকে একশ টাকা দিয়েছিলেন।
এই সময়েই নরেনকে টাকা ধার নিতে হয় বলরামবাবুর কাছ থেকে। এই ৫০০ টাকা ঠাকুরের গৃহী ভক্ত সুরেশবাবু মঠ স্থাপনের জন্য বলরামবাবুর কাছে রেখে যান। মোকদ্দমা যখন তুমুলভাবে চলছে তখন নরেন্দ্রনাথ এই টাকা ধার করেন। দেড় বছর পরে টাকা পাওয়া গেলে এই টাকা শোধ করে দেওয়া হয়। টাকাটা কোম্পানির কাগজে ছিল এবং উকিল অতুল ঘোষের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে মহিমবাবু ও শরৎ মহারাজ বড়বাজারে প্রসাদদাস বড়ালের অফিসে গিয়ে, কাগজ ভাঙিয়ে টাকা শোধ করেন। শোনা যায়, পরে এই টাকায় বেলুড় মঠে ঠাকুরঘরের মার্বেল পাথর কেনা হয়।
*
স্বামীজীর পারিবারিক বিপর্যয়কালে তার দু’জন গুরুভাইয়ের নিঃশব্দ সেবা ও সমর্থন অবিস্মরণীয় রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) ও শরৎ মহারাজ (সারদানন্দ)। স্বামীজীর পিতৃবিয়োগের পর আত্মীয়রা এই পরিবারকে ভিটেমাটিছাড়া করার চেষ্টা চালিয়েছিল, সেই দুর্দিনে জমিদার-পরিবারের সন্তান রাখাল লোকজন সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দখল রক্ষা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই পর্বের অনেক বর্ণনা শোনা যেত অনঙ্গ মহারাজ ওরফে স্বামী ওঙ্কারানন্দের মুখে। অনঙ্গ মহারাজের প্রিয়পাত্র ছিলেন গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু।
স্বামীজির দেহত্যাগের পর জননী ও ভ্রাতাদের অভিভাবকের দায়িত্বও রাখাল মহারাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
জীবনের শেষপর্বেও স্বামীজি তার গুরুভাইকে অনুরোধ করেছিলেন, “রাখাল, আমার শরীর ভাল নয়। আমি শীগগির দেহত্যাগ করবো, তুই আমার মার ও বাড়ির বন্দোবস্ত করে দিস, তাকে তীর্থ দর্শন করাস, তোর ওপর এইটি ভার রইল।”
পারিবারিক বিরোধ একবার শুরু হলে শেষ হতে চায় না, আমাদের অষ্টাদশ পর্ব মহাভারতই তার প্রমাণ। এই বিরোধ যেমন মৃতদেরও ছাড়তে চায় না, তেমন সন্ন্যাসীকেও তার মুক্তিপথ থেকে হিড়হিড় করে আদালতে টেনে আনতে দ্বিধা করে না।
পারিবারিক দ্বন্দ্ব একবার আদালতে গেলে যে দুটো খরচের কোনো নাগাল পাওয়া যায় না তা হলো সময় ও অর্থ। ভুবনেশ্বরী দেবীর ক্ষেত্রেও আমরা দেখবো, এই মামলা শাখাপ্রশাখা বিস্তারিত করে স্বামীজির ৩৯ বছর জীবনকালের দ্বিতীয়ার্ধটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবার প্রবল চেষ্টা করেছিল।
স্বামীজির কনিষ্ঠভ্রাতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, জ্যেষ্ঠভ্রাতা সংসার ত্যাগ করায়, এই সংকটকালে ভুবনেশ্বরীর পাশে কেউ ছিল না। কথাটা কতটুকু সত্য তা পরিমাপ করতে হলে দত্তদের পারিবারিক মামলার বিস্তৃত বিবরণ ইতিহাসের অবগুণ্ঠন সরিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করা প্রয়োজন।
স্বামীজির সব জীবনীগ্রন্থে এই মামলার উল্লেখ থাকলেও সব তথ্য এখনও যাচাই করা হয়নি। কিন্তু ভূপেন্দ্রনাথ স্বামীজির জীবনীকারদের কিছু মন্তব্যকে ভালভাবে নিতে পারেননি। এইসময় স্বদেশ এবং বিদেশ থেকে মেমসায়েবদের এবং অবাঙালিদের কাছে লেখা বিবেকানন্দর কিছু চিঠির পূর্ণবয়ান তখন ভূপেন্দ্রনাথের হাতে ছিল না। গত কয়েকবছরে পরিস্থিতির অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটেছে। মেরি লুইস বার্ক তার অতুলনীয় গবেষণাগ্রন্থে কিছু চিঠির পূর্ণ বয়ান সংগ্রহ করে অনেক বিক্ষিপ্ত অংশ এমনভাবে জুড়ে দিয়েছেন যে তাঁর ছয়খণ্ডের বইটার কয়েক হাজার পাতা মন দিয়ে না পড়লে নানা সমস্যায় জর্জরিত এবং অকারণে বারংবার বিপন্ন বিবেকানন্দকে পুরো জানা যায় না।