মেট্রোপলিটান স্কুল থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর নরেন্দ্রনাথ আরও কিছু করেছিলেন এমন ইঙ্গিত অন্য কোথাও না থাকলেও, উচ্চতম আদালতের নথিপত্রে তার একটি বক্তব্য ইদানীং আমাদের নজর পড়ে যায়। কলকাতা হাইকোর্টের একটি কাগজে লেখা : মেট্রোপলিটান ছাড়বার পরে “অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে ও তার অধীনে একটি কলেজে আমি কিছুদিন অধ্যাপনা করি।” তখন নরেন্দ্রনাথ আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। উকিলের প্রশ্নের মুখে তিনি স্বীকার করছেন : “আমি বেকার।”
.
পারিবারিক সংকটকালে অভাবের সংসারের কয়েকটি টুকরো টুকরো ছবি বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করে আমরা একটা বড় ছবি নিজেরাই সাজিয়ে নিতে পারি। দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের ইচ্ছা, প্রিয় শিষ্য শরৎ (পরে স্বামী সারদানন্দ) একবার নরেনের সঙ্গে দেখা করে।
“নরেন কায়েতের ছেলে, বাপ উকিল, বাড়ি সিমলে।” এইটুকু ইঙ্গিত পেয়ে ১৮৮৫ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসে কলেজফেরত শরৎ নরেনের গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে হাজির। “কেবল একখানি ভাঙ্গা তক্তপোষের ওপর তুলা বের করা একটা গদি, দু’একটা ছেঁড়া বালিশ আর পশ্চিমদিকে একটা কালো মশারি পেরেকের উপর গুটানো; কড়িকাঠ হইতে একটা টানা পাখার ছেঁড়া ঝালর ঝুলিতেছে।” নরেনের শিরঃপীড়া হয়েছে, নাকে কর্পূরের ন্যাস নিতে হতো। শরৎ তখন গুরুভ্রাতাকে ডাকতেন, নরেনবাবু বলে।
পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমা এই পর্বে ক্রমশই তাল পাকিয়ে উঠছে। পরমহংস মহাশয়ের কাছ থেকে উপদেশ এসেছিল, “মোকদ্দমা জোর চালাবে। ফোঁস করবে, কিন্তু কামড়াবে না।”
উকিলবাড়ির ছেলের মন কিন্তু তখন অন্যত্র। অসহায়া ভুবনেশ্বরী শেষ চেষ্টা করেছিলেন।
ছোটছেলেকে নিয়ে ভুবনেশ্বরী কাশীপুরের অন্তিমপর্বে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথের বয়স তখন ছয়। “আমাকে মা নিয়ে গেলেন রামকৃষ্ণের ঘরে। দ্বিতলের একটি প্রশস্ত ঘরের মাঝখানে শয্যায় অর্ধ-শায়িত অবস্থায় রামকৃষ্ণ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে রয়েছেন। ঘরে ঢুকতে তিনি আমাদের উভয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ডাক্তার আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমাকে কথা বলতেই হবে। আপনি এসেছে ভালই হয়েছে। নরেনকে আপনার সঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যান। গিরিশ ওরা সকলে মিলে ওকে সন্ন্যাসীর পোশাক পরিয়েছিল, কিন্তু আমি তখনই বাধা দিয়ে বলেছিলাম–তা কেমন করে হয় নরেন, তোমার বিধবা মা এবং একটি শিশু ভাই রয়েছে দেখবার। তোমার তো সন্ন্যাসী হওয়া সাজে না।’ একথা বলার পরে নরেন্দ্রনাথ মা ও আমার সঙ্গে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। আসবার সময় ঘোড়ার গাড়িতে বসে মা নরেন্দ্রনাথকে রামকৃষ্ণের কথাগুলো বললেন। নরেন্দ্রনাথ উত্তরে বললেন, ‘তিনি চোরকে বলেন চুরি করতে, আর গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাকতে।”
*
বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর ভুবনেশ্বরী যে দশপ্রহরণধারিণী দুর্গতিনাশিনীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তা সংসারী বাঙালির মনে চিরদিন বিস্ময়ের সৃষ্টি করবে। আমার মতন ভুক্তভোগীরা বুঝবেন, তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। যে সংসারে প্রতি মাসে হাজার টাকা খরচ হতো তা নামিয়ে আনলেন তিরিশ টাকায়। শুরু করলেন গহনাপত্র বিক্রি করা।
এ বিষয়ে স্বামী সারদানন্দর সশ্রদ্ধ প্রতিবেদন : “স্বামীর মৃত্যুর পর দারিদ্র্যে পতিত হইয়া ভুবনেশ্বরীর ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও তেজস্বিতা প্রভৃতি গুণরাজী বিশেষ বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল। …তাকে একদিনের জন্য বিষণ্ণ দেখা যাইত না।…তাহার অশেষ সদ্গুণসম্পন্ন জ্যেষ্ঠপুত্র নরেন্দ্রনাথ নানা প্রকার চেষ্টা করিয়াও অর্থকর কোনরূপ কাজকর্মের সন্ধান পাইতেছেন না এবং সংসারের উপর বীতরাগ হইয়া চিরকালের নিমিত্ত উহা ত্যাগের দিকে অগ্রসর হইতেছেন–এইরূপ ভীষণ অবস্থায় পতিত হইয়াও শ্রীমতী ভুবনেশ্বরী যেরূপ ধীরস্থির ভাবে নিজ কর্তব্য পালন করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিয়া তাহার উপর ভক্তি-শ্রদ্ধার স্বতই উদয় হয়।”
বাবার মৃত্যুর পরে বিব্রত নরেনের প্রায়ই মাথার প্রবল যন্ত্রণা হতো। আমরা আগেই দেখেছি, মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য তিনি কর্পূরের ন্যাস নিতেন। মা একখানি চেলীর কাপড় পরতেন। কাপড়টা ছিঁড়ে যাওয়ায় নরেনকে বলেন, একখানা কাপড় হলে আহ্নিকের সুবিধে হয়। কাপড় দেওয়ার ক্ষমতা নেই, নরেন মাথা হেঁট করে চলে গেল। এই সময় পরমহংসদেব এক ভক্তের কাছ থেকে একটা কাপড় পেয়ে নরেনকে বললেন, “তুই গরখানা নে, তোর মা পরে আহ্নিক করবেন।” নরেন নিল, কিন্তু পরমহংসদেব নিজেই অন্য লোকের মাধ্যমে কাপড়খানা শ্রীমতী ভুবনেশ্বরীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
পরমহংসদেবের অন্ত্যলীলা শুরু হওয়া থেকে পরিব্রাজক রূপে বিবেকানন্দর বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে কেউ কেউ দয়াপরবশ হয়ে নরেন্দ্রকে অর্থসাহায্য করেছিলেন। কথামৃতে আছে, কেউ তাকে একশ টাকা ধার দিয়েছিলেন, তার নাম বলা হয়নি, কিন্তু এখন আমরা ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের শেষ বয়সের উক্তি থেকে জানি, স্বয়ং মাস্টারমশায় টাকাটা দান করেছিলেন। তাতে নরেনের পরিবারের তিনমাসের সংসারখরচের ব্যবস্থা হয়েছিল।
কাশীপুরের প্রথম দিকের একটি বর্ণনা মনে দাগ কাটে। নরেন্দ্রনাথ শ্ৰীমকে বললেন, “আজ সকালে বাড়ি গেলাম। সকলে বকতে লাগল। আর বললেন–”কি হো হো করে বেড়াচ্ছিস? আইন এগজামিন এত নিকটে, পড়াশুনা নাই, হো হো করে বেড়াচ্ছিস!