.
ঘটনাস্রোত থমকে দাঁড়ায়নি। নরেন্দ্রর আত্মজীবনবর্ণনা আমাদের কাছেই রয়েছে, “এত দুঃখ কষ্টেও এতোদিন আস্তিক্যবুদ্ধির বিলোপ কিংবা ঈশ্বর মঙ্গলময়–একথায় সন্দিহান হই নাই। প্রাতে নিদ্রাভঙ্গে তাহাকে স্মরণ-মনন পূর্বক তাহার নাম করিতে করিতে শয্যাত্যাগ করিতাম। একদিন ঐরূপ শয্যাত্যাগ করিতেছি, এমন সময় পার্শ্বের ঘর হইতে মাতা শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘চুপ কর ছোঁড়া! ছেলেবেলা থেকে কেবল ভগবান ভগবান। ভগবান সব তো কল্লেন!’ কথাগুলিতে মনে ভীষণ আঘাত পাইলাম। স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, ভগবান কি বাস্তবিক আছেন এবং থাকিলেও আমাদের সকরুণ প্রার্থনা কি শুনিয়া থাকেন? তবে এত যে প্রার্থনা করি, তাহার কোন উত্তর পাই না কেন? শিবের সংসারে এত অশিব কোথা হইতে আসিল? মঙ্গলময়ের রাজত্বে। এত প্রকার অমঙ্গল কেন?”
আরও বিস্ফোরণ আছে। “গোপনে কোন কার্যের অনুষ্ঠান করা আমার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল।…সুতরাং ঈশ্বর নাই। অথবা যদি থাকেন তো তাহাকে ডাকিবার জন্য কোন সফলতা বা প্রয়োজন নাই, একথা হাঁকিয়া ডাকিয়া লোকের নিকট সপ্রমাণ করিতে এখন অগ্রসর হইব, ইহাতে বিচিত্র কি? ফলে স্বল্পদিনেই রব উঠিল, আমি নাস্তিক হইয়াছি এবং দুশ্চরিত্র লোকের সহিত মিলিত হইয়া মদ্যপানে ও বেশ্যালয়ে গমনে পর্যন্ত কুণ্ঠিত নই।”
এই সময়ে পাড়ার রিপোর্টও ভাল নয়। এক প্রতিবেশী তার বন্ধু শরৎচন্দ্রকে (পরে স্বামী সারদানন্দ) বলেন, “এই বাটিতে একটা ছেলে আছে, তাহার মতো ত্রিপণ্ড ছেলে কখনও দেখিনি; বি এ পাশ করেছে বলে যেন ধরাকে সরা দেখে। বাপখুডোর সামনেই তবলায় চাটি দিয়ে গান ধরলে, পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে দিয়েই চুরুট খেতে খেতে চললো–এইরূপ সকল বিষয়ে।”
বি এ পাস করেও কলকাতার অফিসপাড়ায় মাসিক ১৫ টাকা মাইনের চাকরি জোগাড় করতে ভবিষ্যতের বিবেকানন্দ যে অসমর্থ হয়েছিলেন তা মার্কিন দেশের ভক্তদের তিনি সুযোগ পেলেই শুনিয়েছেন। এখনকার যুগে যাঁদের ধারণা সকালে কলকাতার চাকরিবাজার খুব লোভনীয় ছিল তারা আশা করি প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারছেন।
সম্বলহীন, অন্নহীন নরেন্দ্রনাথ দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কথামৃতের রচনাকার শ্রীমর স্নেহনজরে পড়লেন। তিনি তখন বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক। তার চেষ্টায় নরেন্দ্রনাথ সুকিয়া স্ট্রিটে ইস্কুলের প্রধান শাখায় তিনমাস পড়ান। তারপর সিদ্ধেশ্বর লেন, চাপাতলায় মেট্রোপলিটানের একটা শাখা খোলা হল, ঐখানে হেডমাস্টারের কাজ পেলেন নরেন্দ্রনাথ।
ঐ স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন বিদ্যাসাগরের জামাই–তার বিষনজরে পড়ে গেলেন হতভাগ্য নরেন্দ্রনাথ। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা কলকাঠি এমনভাবে নাড়লেন যে ক্লাস নাইন ও টেনের ছেলেরা যৌথভাবে পিটিশন করলো, নতুন হেডমাস্টার পড়াতে পারে না। জগৎকে নতুন শিক্ষা দেবার জন্যে যাঁর আবির্ভাব, দলবাজির জোরে তার ছাত্ররাই কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করছে, লোকটা পড়াতে পারে না।
বিদ্যাসাগরমশায় পিটিশন দেখেই খোঁজখবর না নিয়েই নির্দেশ দিলেন, তা হলে নরেন্দ্রকে বলো–আর না আসে।নতমস্তকে এই নির্দেশ মেনে নেওয়া ছাড়া নরেন্দ্রর আর কোনো পথ ছিল না। আশ্চর্য এই,নরেন্দ্রনাথের মনে পরবর্তীকালেও কোনো তিক্ততা ছিল না। তাকে সবসময় বিদ্যাসাগরের প্রশংসা করতে দেখেছি আমরা।
মেট্রোপলিটন ইস্কুলে প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে ছিলেন পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের নমস্য সন্ন্যাসী স্বামী বোধানন্দ। পড়তেন নিচু ক্লাসে, কিন্তু তার বেশ মনে ছিল, আলখাল্লা, চাপকান ও ট্রাউজার পরে নরেন্দ্রনাথ ইস্কুলে আসতেন। সেইসঙ্গে গলায় থাকতো ৬ ফুট লম্বা চাদর, এক হাতে ছাতা এবং অন্যহাতে এনট্রান্স ক্লাসের পাঠ্যপুস্তক।
বিদ্যাসাগরের চাকরি হারিয়ে সিটি স্কুলে একটা মাস্টারির চাকরির জন্য শিবনাথ শাস্ত্রীমশাইকে ধরাধরি করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। বলাবাহুল্য, শাস্ত্রীমশায় দায়টা এড়িয়ে যান। আরও বলে রাখা ভাল, প্রায় এই পর্বে রামকৃষ্ণ ভক্ত শ্ৰীম নিজেই বিদ্যাসাগরের রোষানলে পড়েন। অসুস্থ রামকৃষ্ণের ওখানে ঘন ঘন যাতায়াতের জন্য ছেলেদের পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হয়নি, এমন ইঙ্গিত পাওয়ায় মানসম্মান রক্ষার জন্য ভবিষ্যতের কথা না ভেবেই মাস্টারমশাই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। ঠাকুরকে যখন তিনি খবরটা দিলেন তখন অসুস্থ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ তিনবার বললেন, “ঠিক করেছ, ঠিক করেছ, ঠিক করেছ।” চাকরি-বাকরির ব্যাপারে ঠাকুরকে এতো সাফসুফ কথা বলতে আর কখনও শোনা যায়নি।
সৌভাগ্যবশত শ্ৰীমকে অন্নচিন্তায় কাতর হতে হয়নি, কারণ স্যর সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি মহাশয় তাঁর নবপ্রতিষ্ঠিত রিপন স্কুলে সাদরে ডেকে নিয়ে যান বহুগুণের অধিকারী মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে।
কিন্তু ভবিষ্যতের বিবেকানন্দ? শোনা যায়, তিনি গয়ার কাছে কোনো জমিদারি সেরেস্তায় সামান্য একটা কাজ জুটিয়েছিলেন, যদিও শেষপর্যন্ত সেখানে যাওয়া হয়নি। কারণ বাবার মৃত্যুর একবছর পরে ১৮৮৫ সালের মার্চ মাসে নরেন্দ্রনাথ গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বলে আমরা আন্দাজ করতে পারি। এইসব বর্ণনা পাঠ করেই নিন্দুকরা সময় বুঝে বাঁকা প্রশ্ন তুলেছেন, ইনি কি ‘অভাব-সন্ন্যাসী’ না ‘স্বভাব-সন্ন্যাসী’?