বাবার শ্রাদ্ধশান্তির পরেই দাদা নরেন্দ্রনাথ বুঝলেন, আর্থিক অবস্থা ভয়াবহ। তখন ছোটভাই নিতান্তই শিশু। জ্যেষ্ঠভ্রাতা স্বয়ং এসময়কার বৃত্তান্ত আমাদের জন্যে মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করে গিয়েছেন :
“মৃতাশৌচের অবসান হইবার পূর্ব হইতেই কর্মের চেষ্টায় ফিরিতে হইয়াছিল। অনাহারে ছিন্নবস্ত্রে নগ্নপদে চাকরির আবেদন হস্তে লইয়া মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রে অফিস হইতে অফিসান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতাম … কিন্তু সর্বত্রই বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিতে হইয়াছিল। সংসারের সহিত সেই প্রথম পরিচয়েই বিশেষভাবে হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল, স্বার্থশূন্য সহানুভূতি এখানে অতীব বিরল দুর্বলের, দরিদ্রের এখানে স্থান নাই। দেখিতাম, দুইদিন পূর্বে যাহারা আমাকে কোন বিষয়ে কিছুমাত্র সহায়তা করিবার অবসর পাইলে আপনাদিগকে ধন্য জ্ঞান করিয়াছে, সময় বুঝিয়া তাহারাই এখন আমাকে দেখিয়া মুখ বাঁকাইতেছে এবং ক্ষমতা থাকিলেও সাহায্য করিতে পশ্চাৎপদ হইতেছে। দেখিয়া শুনিয়া কখনো কখনো সংসারটা দানবের রচনা বলিয়া মনে হইত। মনে হয়, এই সময়ে একদিন রৌদ্রে ঘুরিতে ঘুরিতে পায়ের তলায় ফোস্কা হইয়াছিল এবং নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া গড়ের মাঠে মনুমেন্টের ছায়ায় বসিয়া পড়িয়াছিলাম। দুই একজন বন্ধু সেদিন সঙ্গে ছিল, অথবা ঘটনাক্রমে ঐস্থানে আমার সহিত মিলিত হইয়াছিল। তন্মধ্যে একজন বোধ হয় আমাকে সান্ত্বনা দিবার জন্য গাহিয়াছিল—’বহিছে কৃপাঘন ব্রহ্মনিঃশ্বাস পবনে।’
“শুনিয়া মনে হইয়াছিল মাথায় যেন কে গুরুতর আঘাত করিতেছে। মাতা ও ভ্রাতাগণের নিতান্ত অসহায় অবস্থার কথা মনে উদয় হওয়ায় ক্ষোভে নিরাশায় ও অভিমানে বলিয়া উঠিয়াছিলাম, ‘নে নে চুপ কর! ক্ষুধার তাড়নায় যাহাদিগের আত্মীয়বর্গকে কষ্ট পাইতে হয় না, গ্রাসাচ্ছাদনের তাড়া যাহাদিগকে কখনো সহ্য করতে হয় নাই, টানাপাখার হাওয়া খাইতে খাইতে তাহাদিগের নিকট ঐরূপ কল্পনা মধুর লাগিতে পারে; আমারও একদিন লাগিত। কঠোর সত্যের সম্মুখে উহা এখন বিষম ব্যঙ্গ বলিয়া বোধ হইতেছে।”
অন্য পরিস্থিতিতে নরেন্দ্রনাথ একদিন মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে যা বলেছিলেন তাও কথাসূত্রে লিপিবদ্ধ আছে : “অনেক দুঃখ কষ্ট পেয়ে তবে এই অবস্থা হয়েছে, মাস্টারমশাই, আপনি দুঃখকষ্ট পান নাই তাই; জানি দুঃখকষ্ট না পেলে ঈশ্বরের হস্তে সমর্পণ হয় না।”
পারিবারিক অবস্থা সম্বন্ধে বিলুর নিজের মুখেই আরও কথা : “প্রাতঃকালে উঠিয়া গোপনে অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম, গৃহে সকলের পর্যাপ্ত আহার্য নাই, সেদিন মাতাকে আমার নিমন্ত্রণ আছে, বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোনদিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোনদিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম। অভিমানে ঘরে বাহিরে কাহারও নিকটে ঐকথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না।”
ধনী বন্ধু কিছু ছিল, কিন্তু তারাও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এবিষয়ে জানতে চেষ্টা করেনি। তাদের মধ্যে বিরল দুই-একজন কখনও কখনও বলতো, “তোকে আজ এত বিষণ্ণ ও দুর্বল দেখছি, কেন বল দেখি? একজন কেবল আমার অজ্ঞাতে অন্যের নিকট হইতে আমার অবস্থা জানিয়া লইয়া বেনামী পত্ৰমধ্যে মাতাকে সময়ে সময়ে টাকা পাঠাইয়া আমাকে চিরঋণে আবদ্ধ করিয়াছিল।”
তখনকার অবস্থা স্বামীজির মুখেই শুনুন। “যৌবনে পদার্পণপূর্বক যে সকল বাল্যবন্ধু চরিত্রহীন হইয়া অসদুপায়ে যৎসামান্য উপার্জন করিতেছিল, তাহাদিগের কেহ কেহ আমার দারিদ্র্যের কথা জানিতে পারিয়া সময় বুঝিয়া দলে টানিতে সচেষ্ট হইয়াছিল। তাহাদিগের মধ্যে যাহারা ইতঃপূর্বে অবস্থার পরিবর্তনে সহসা পতিত হইয়া একরূপ বাধ্য হইয়াই জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য হীনপথ অবলম্বন করিয়াছিল, দেখিতাম তাহারা সত্যসত্যই আমার জন্য ব্যথিত হইয়াছে। সময় বুঝিয়া অবিদ্যারূপিনী মহামায়াও এইকালে পশ্চাতে লাগিতে ছাড়েন নাই। এক সঙ্গতিসম্পন্না রমণীর পূর্ব হইতেই আমার উপর নজর পড়িয়াছিল। অবসর বুঝিয়া সে এখন প্রস্তাব করিয়া পাঠাইল, তাহার সহিত তাহার সম্পত্তি গ্রহণ করিয়া দারিদ্র-দুঃখের অবসান করিতে পারি! বিষম অবজ্ঞা ও কঠোরতা প্রদর্শনে তাহাকে নিবৃত্ত করিতে হইয়াছিল। অন্য এক রমণী ঐরূপ প্রলোভিত করিতে আসিলে তাহাকে বলিয়াছিলাম, বাছা এই ছাই-ভস্ম শরীরটার জন্যে এতদিন কত কি তো করিলে! মৃত্যু সম্মুখে–তখনকার সম্বল কিছু করিয়াছ কি? হীনবুদ্ধি ছাড়িয়া ভগবানকে ডাক।”
ঘটনাস্রোতে আর একবার কয়েকজন বন্ধু নরেন্দ্রনাথকে সুরাপানের পরামর্শ দেয় এবং সুচতুরভাবে এক বারাঙ্গনার কাছে জর্জরিত নরেনকে নিয়ে যায়। তাকে বিদায় করে দিয়ে নরেন্দ্রনাথ সবাইকে বলতে লাগলেন, “আমি আজ মদ ও মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদ করেছি।” বাড়িতে গিয়ে নিজের মাকেও ওই কথা তিনি প্রকাশ করেন। খবরটা দিয়েছেন জীবনীকার প্রমথনাথ বসু।
“এক সন্ধ্যায় তাহার জনকয়েক বন্ধু তাহাকে গাড়ি করিয়া তাহাদের কলিকাতার উপকণ্ঠস্থিত এক উদ্যানবাটীতে লইয়া যাইতে চাহিলেন… গানবাজনা খুব হইল, নরেন্দ্রও যথারীতি যোগ দিলেন, কিছুপরে তিনি ক্লান্ত বোধ করিলে বন্ধুরা পার্শ্ববর্তী একখানি ঘর দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, তিনি সেখানে গিয়া বিশ্রাম করিতে পারেন। তিনি একাকী শুইয়া আছেন এমন সময় বন্ধুদের দ্বারা প্রেরিত একটি যুবতী সেই কক্ষে উপস্থিত হইল…সে ক্রমে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করিল এবং ঐ গৃহে আসার অভিপ্রায়ও খুলিয়া বলিল।…নরেন্দ্র বাহিরে যাইবার জন্য পা বাড়াইয়া বলিলেন, “মাপ করবেন; আমায় এখন যেতে হবে।…আপনার মঙ্গল হোক এই আমি চাই। আপনি যদি বুঝে থাকেন যে, এভাবে জীবনযাপন করা পাপ, তবে একদিন না একদিন আপনি এ থেকে উদ্ধার পাবেন নিশ্চয়।”